ঢাবিতে সঠিক সময় পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় না

মাহমুদ নকীব

মার্চ ২১, ২০২৪, ০৮:১০ পিএম

ঢাবিতে সঠিক সময় পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় না

ছবি: সংগৃহীত

সঠিক সময়ে প্রকাশিত হয় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোর ফলাফল। তাত্ত্বিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সেমিস্টার পদ্ধতিতে ছয় সপ্তাহ ও বর্ষ পদ্ধতিতে ৮ সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের নিয়ম থাকলেও সেই নিয়মের থোরাই কেয়ার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভাগ ও ইনিস্টিটিউটগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি অনুষদ ও ১০টি ইনিস্টিটিউট মিলিয়ে গত এক বছরে ৫৮৪টি পরীক্ষার মধ্যে সঠিক সময়ে মাত্র ৩৭টি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে।

৭ কলেজের সংযুক্তি, শিক্ষকদের গাফিলতি, টিচার অ্যাসিস্ট্যান্ট না থাকাই রেজাল্ট প্রকাশে দেরি হওয়ার মূল কারণ বলে জানা যায়। এতে উচ্চশিক্ষাসহ ক্যারিয়ার নিয়ে নানা ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

ফল প্রকাশে কেন দেরি হচ্ছে এ নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের অনুসন্ধানে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) যেসব বিভাগ অধিভুক্ত ৭ কলেজেও রয়েছে সেসব বিভাগে ফল প্রকাশে দেরি হচ্ছে। যেমন বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, ইসলামিক স্টাডিজের মতো বিভাগগুলো গড়ে ৬-৭ সপ্তাহ করে দেরি করে ফল প্রকাশ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতির গড়ার কারিগর। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কথা ভাবছেন না। আমাদের বিভাগের প্রতিটি ফলাফল পরীক্ষা শেষ হওয়ার প্রায় ৩-৪ মাস পর পর প্রকাশিত হয়। এর কারণ হিসেবে আমি জানতে পেয়েছি, আমাদের বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক ৭ কলেজের পরীক্ষাগুলোর খাতা কাটেন। সাত কলেজের বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের খাতা কাটতে প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষকরা নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের ওপর বাজি রেখে ৭ কলেজের খাতা কাঁটায় ব্যস্ত থাকেন। এতে আমাদের ফলাফল প্রকাশে দেরি হয়।’

ফল প্রকাশে বিলম্বের অন্যতম কারণ শিক্ষকদের গাফিলতি। শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া, টক শো করে বেড়ানোসহ নানা ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে তারা উত্তরপত্র মূল্যায়নে গড়িমসি করেন। এই গাফিলতির সমাধান হতে পারতো টিচার্স অ্যাসিস্ট্যান্ট। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনকি বাংলাদেশের বেসরকারি দুই-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার্স অ্যাসিস্ট্যান্টের ব্যবস্থা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে শিক্ষকদের একাডেমিক কাজে সহায়তাসহ পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন টিচার অ্যাসিস্ট্যান্টরা। শিক্ষকরা সম্মানির মাধ্যমে মাস্টার্সে পড়ুয়া বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের টিচার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।

শিক্ষার্থী আফরিন সুমাইয়া বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষকরা নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। উন্নত বিশ্বের মতো এ বিশ্ববিদ্যালয়েও টিচার অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এতে শিক্ষকদের ওপর চাপ কমবে ও শিক্ষার্থীদেরও নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয় হতে বিভিন্ন বিভাগ ও ইনিস্টিটিউটগুলোর ফলাফল প্রকাশের তথ্য আসে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের কাছে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর গত এক বছরে অনুষ্ঠিত ১৪৯টি পরীক্ষার মধ্যে মাত্র একটি পরীক্ষার ফল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সঠিক সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ফল প্রকাশে ৮-১৫ সপ্তাহ সময় নেয় এসব বিভাগ। এরমধ্যে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে পরীক্ষা শেষ হওয়ার প্রায় ৩০ সপ্তাহ পরে।

বিজ্ঞান অনুষদের চিত্র আরও নাজুক। গত এক বছরে অনুষ্ঠিত ২৪টি পরীক্ষার মধ্যে একটিরও ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশিত হয়নি। এর মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি পরীক্ষা ৩৪ সপ্তাহ ও থিওরিটিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটেশনাল কেমিস্ট্রি বিভাগের একটি পরীক্ষার ফলাফল ২৫ সপ্তাহ পরে প্রকাশিত হয়েছে। এ অনুষদের প্রতিটি বিভাগই ফলাফল প্রকাশে গড়ে ১৫ সপ্তাহ করে সময় নিয়েছে।

কলা অনুষদের ১৭২টি পরীক্ষার মধ্যে মাত্র চারটি পরীক্ষার ফলাফল সঠিক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে।

এদিকে আইন অনুষদের পরীক্ষার ফল যেন সোনার হরিণ। প্রাপ্ত নথি থেকে দেখা যায়, বর্ষ পদ্ধতিতে ৮ সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের নিয়ম থাকলেও এই বিভাগের পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয় ২২-২৮ সপ্তাহ পরে।

জীববিজ্ঞান অনুষদে ৪০টি পরীক্ষার মধ্যে মাত্র চারটি পরীক্ষার ফলাফল যথাযথ সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বোটানি, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি করে পরীক্ষার ফলাফল প্রায় ২৫ সপ্তাহ পরে প্রকাশিত হয়েছে। এই অনুষদের বিভাগগুলোর ফলাফল প্রকাশের সময় গড়ে ১৪ সপ্তাহ করে।

চারুকলা অনুষদের ফলাফল প্রকাশের সময় তুলনামূলক কম। এই বিভাগে অনুষ্ঠিত ৪৪টি পরীক্ষার মধ্যে ১৭টি যথাযথ সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি পরীক্ষার বেশিরভাগই নির্ধারিত সময়ের ১-২ সপ্তাহ দেরি করে প্রকাশিত হয়েছে। তবে, এই অনুষদের হিস্টি অফ আর্ট বিভাগের ফলাফল প্রকাশ হয় সবচেয়ে দেরিতে। এই বিভাগ রেজাল্ট দিতে ১১-১৮ সপ্তাহ সময় নেয়।

ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের ৪৪টি পরীক্ষার মধ্যে একটি এবং আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অনুষদের ২৭টি পরীক্ষার মধ্যে একটি মাত্র সঠিক সময়ে প্রকাশ হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি অনুষদের ৭২টি পরীক্ষার মধ্যে আটটির ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময় কাঠামোতে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের একটি পরীক্ষার ফল প্রকাশে লেগেছে ৪১ সপ্তাহ।

ফলফল প্রকাশে দেরি হওয়ার শিক্ষার্থীদের নানা ঝামেলার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স বিভাগের এস এম জান্নাতুল নাঈম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রাইভেট জবে আবেদন করে। আবার অনেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চায়। কিন্তু ফলাফল প্রকাশে দেরি হওয়ার শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সময়মত হাতে পাচ্ছে না। এতে তাদের পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। আবার ঢাবির সিংহভাগ শিক্ষার্থী চায় বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে। কিন্তু ফলাফল প্রকাশে দেরি হওয়ার এ চাকুরীর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তায় ভুগছে। আমার দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আরো দায়িত্বশীল হয়ে যেকোনো ধরনের পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশে দেরি না করুক। যাতে শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে না হয়।’

তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শোয়াইব হোসেন সাদ বলেন, ‘আগের সিমেস্টারগুলোর ফলাফলের ওপর নতুন সিমেস্টারে আমি নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করবো তার অনেকাংশেই নির্ভর করে। কিন্তু বর্তমানে এক সেমিস্টারের ফলাফল পরবর্তী সেমিস্টারের মিড পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও প্রকাশিত হয় না। তাই নিজেকে ইমপ্রুভ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ জন্য শিক্ষকদের আরও প্রফেশনাল হওয়া উচিত।’

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বাহালুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের অফিসে বিভাগ-ইনস্টিটিউট থেকে ফল পাঠানো হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা প্রকাশ করি। ফল দেরিতে হওয়ার পেছনে আমাদের দপ্তরের কোনো কারণ নেই। শিক্ষকরা যখনই আমাদের ফল পাঠান, আমরা তা দ্রুত সময়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করি।’

ফল প্রকাশের দেরি হওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপ-উপাচার্য (প্রোভিসি) শিক্ষা অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, ‘অনেকগুলো বিভাগে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ থাকে। ওই ইন্টার্নশিপের রিপোর্ট জমা দিতে হয়। এরপর তা মূল্যায়ন হয়। যার কারনে একটি দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হয়।’

এছাড়া ৭ কলেজের কারণে শিক্ষকদের বিশাল একটি চাপের মধ্যে থাকতে হয় সেটি জানান ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার। তিনি বলেন, ‘নিজ বিভাগের খাতা ছাড়াও শিক্ষকদের কাছে ৭ কলেজের একটি বিশাল সংখ্যক খাতা চলে আসছে। যেটিও ফলাফল প্রকাশের দেরীর অন্যতম কারণ বলে জানান তিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফল প্রকাশে যে দেরি হচ্ছে সেটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। এই সময় কমাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন অটোমেটিক ইভালুয়েশনের সিস্টেমের উদ্যোগ নিয়েছে। যা এরই মধ্যে একটি অনুষদের মাধ্যমে শুরু হয়ে গেছে এবং সময়ের সঙ্গে এই মূল্যায়ন পদ্ধটির মধ্যে সব অনুষদ ও ইনস্টিটিউটকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই উদ্যোগ সর্বজনীন হলে ফল প্রকাশে যে দীর্ঘসূত্রীতা সেটি দূর হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল দ্য রিপোর্ট লাইভকে বলেন, ‘ফল প্রকাশে আমাদের সহকর্মীদের (শিক্ষকদের) গাফিলতি আছে সেটি অবশ্যই বলবো। এছাড়া সাধারণত একজন শিক্ষকের  কাছে নিজ বিভাগের কয়েকটি কোর্সের খাতা ও অধিভুক্ত সাত কলেজের খাতা আসে। তাই একজন শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই সময়ের মধ্যে খাতা মূল্যয়ন শেষ করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার থাকে না। ফলাফল যে দেরি হচ্ছে এটি সমাধানে আমরা কিছু নিয়ম পরিবর্তন করেছি। এসব নিয়ম একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন শেষে সিন্ডিকেটের উত্থাপিত হবে। আশা করি, সিন্ডিকেটে অনুমোদন হলে এ বিষয়টির ডেভেলপমেন্ট হবে বলে আমরা আশা করছি।’

Link copied!