ডাকসু ২০১৯: কে কোথায়, এখন কি করছেন

সালমান ইবনে সাঈদ শাওন

জুলাই ৬, ২০২৫, ০৮:৩৭ পিএম

ডাকসু ২০১৯: কে কোথায়, এখন কি করছেন

ডাকসু ২০১৯: নায়ক, খলনায়ক, হারিয়ে যাওয়া চরিত্র।

শেষবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। ছাত্রলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে জয়ী হলেও ভিপি হয়েছিলেন নুরুল হক নূর। আর পরাজয়ের তালিকায় ছিলেন এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামও। ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কেউ এখন ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী, কেউ বা জেলে। চলুন জেনে নেই সেই সময়ের আলোচিত নামগুলো আজ কোথায়?

নুরুল হক নূর বর্তমানে যিনি ভিপি নূর নামেই বেশি পরিচিত। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ‍‍`বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদ ‍‍` এর প্যানেল থেকে ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়ে সহ-সভাপতি(ভিপি) পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি বর্তমানে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি হিসাবে আছেন।

আর ভিপি পদে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ভিপি পদে ভোট পেয়েছিলেন ৯ হাজার ১২৯টি। তিনি ছিলেন নুরুল হক নুরের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। পরবর্তীতে তিনি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-১ আসন থেকে এমপি পদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর তার নামে ভাঙচুর ও চুরির মামলা হয়। বর্তমানে তিনি পলাতক অবস্থায় আছেন।

ছাত্রদল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করেন তৎকালীন ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি মোট ২৪৫ টি ভোট পান। তিনি এখনো ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন।

স্বতন্ত্র জোট প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করেন জিন প্রকৌশল ও জীব প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী  অরণি সেমন্তি খান। নির্বাচনে ২ হাজার ৬৭৬ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক  হিসেবে কর্মরত আছেন। বাম জোটের ভিপি প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী। ১ হাজার ২১৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থানে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির  রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন।

জিএস পদে হয়েছিল হাড্ডাহাডি লড়াই

২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ১০ হাজার ৪৮৪ ভোট পেয়ে জিএস পদে নির্বাচিত হন। জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে তিনি পালিয়ে কলকাতা চলে যান। এবং সেখানকার একটি সংবাদমাধ্যমে তাকে দেখা যায়। বর্তমানে তিনি পলাতক অবস্থায় কলকাতায় আছেন। 

তৎকালীন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খান জিএস পদে ৬ হাজার ৬৩ ভোট পেয়ে গোলাম রাব্বানীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। বর্তমানে তিনি গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন।

স্বতন্ত্র থেকে জিএস পদে স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের প্রার্থী সাংবাদিক সমিতির নেতা আসিফুর রহমান ত্বাসীন ৪ হাজার ৬২৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে  কর্মরত আছেন।

ছাত্রদল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করেন আনিসুর রহমান অনিক।তিনি মোট ৪৬২ টি ভোট পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি পদে আছেন । বাম জোট থেকে নির্বাচন করেন ফয়সাল মাহমুদ সুমন। নির্বাচনে তিনি ২৪৭ ভোট পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি এনজিওতে কর্মরত আছেন।

স্বতন্ত্র জোট প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করেন শাফি আব্দুল্লাহ। নির্বাচনে ১ হাজার ৫১২ ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থানে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনিও শিক্ষতার সাথে যুক্ত আছেন।

সাদ্দাম হোসেনের রাজনৈতিক শক্ত অবস্থান

এজিএস পদে ডাকসু নির্বাচনে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ১৫ হাজার ৩০১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৫ হাজার ৮৯৬ ভোট পেয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্ব ছিলেন তৎকালীন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ফারুক হোসেন। পরবর্তীতে সাদ্দাম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে তিনি পালিয়ে যান। অনেকদিন আত্মগোপনে থাকার পরে সম্প্রতি তাকে ভারতের বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়। বর্তমানে তিনি পলাতক অবস্থায় ভারতে আছেন।

ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল এই পদে ২৯৪ ভোট পেয়ে তিনি ছিলেন পঞ্চম অবস্থানে। বর্তমানে তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত।

এদিকে ১০ হাজার ৭০০ ভোট পেয়ে সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মাজহারুল কবির শয়ন। ৫ ই আগস্ট তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। অভ্যুত্থানের পর তিনি পালিয়ে প্রথমে নেপাল পরবর্তীতে সেখান থেকে পালিয়ে নিউইয়র্কে আশ্রয় নেন। মাঝে তাকে নিউইয়র্কে বন্ধুদের সাথে পার্টি ও পিকনিক করতে দেখা যায়।

নাসির পাটোয়ারী ও আখতার হোসেন এখন একই দলে

আখতার হোসেন  ৯ হাজার ১৯০ ভোট পেয়ে তিনি ডাকসুতে সমাজসেবা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সহ-সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি পদেও ছিলেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর সদস্য সচিব পদে আছেন। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী সমাজসেবা সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে আখতার হোসেনের কাছে পরাজিত হন। বর্তমানে তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর মূখ্য সংগঠক।

জুলাই আন্দোলনের পোস্টার বয় নাহিদের হয়েছি ভরাডুবি

আসিফ তালুকদার ১০ হাজার ৭৯৯ ভোট পেয়ে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে সংস্কৃতি সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য নেদারল্যান্ডস চলে যান এবং বর্তমানে তিনি সেখান থেকে অনলাইনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সরব আছেন। একই পদে সাধারণ শিক্ষার্থী পরিষদের নাহিদ ইসলাম ৩ হাজার ৫৮৪ ভোট পেয়ে আসিফ তালুকদারের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরাজিত হন। বর্তমানে নাহিদ ইসলাম জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক হিসাবে আছেন।

ছাত্রদলের একমাত্র লড়াই

কানেতা ইয়া লাম লাম  ২০১৯ সালের ডাকসুতে ছাত্রদল থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলেন কনেতা ইয়া লাম লাম। কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদে তিনি ৭ হাজার ১১৯ ভোট পেয়ে ছাত্রলীগের বি এম লিপি আক্তারের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। বিএম লিপি আক্তার বর্তমানে আইন পেশার সাথে যুক্ত রয়েছেন। এদিকে কানেতা ইয়া লাম লাম কানাডায় উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাকতার সাথে জড়িত রয়েছেন।

তানভীর হাসান সৈকত ১০ হাজার ৮০৫ ভোট পেয়ে তৎকালীন ডাকসুতে সদস্য পদে নির্বাচিত হন তানভীর হাসান সৈকত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে গনরুম  প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট তিনি পালিয়ে যেতে গেলে বিমানবন্দরে আটকে দেয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে ১৪ ই আগস্ট হত্যা মামলার সহ বিভিন্ন মামলায় তাকে নিকুঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বর্তমানে তিনি জেলে আছেন।

শাকিল আহমেদ তানভীর ৯ হাজার ৪৭ ভোট পেয়ে তৎকালীন ডাকসুতে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন শাকিল আহমেদ তানভীর। গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি পালিয়ে ভারতে চলে যান। সম্প্রতি তাকে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়।

শামস ই নোমান তৎকালীন ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামস ই নোমান ১২ হাজার ১৬৩ ভোট পেয়ে ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন ডাকসুতে। বর্তমানে তিনি পলাতক অবস্থায় আছেন।

আরিফ ইবনে আলী ২০১৯ সালের ডাকসুতে ৯ হাজার ১৫৪ ভোট পেয়ে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন আরিফ ইবনে আলী। বর্তমানে তিনি আইসিটি বিভাগের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরে চাকরি করছেন।

তিলোত্তমা শিকদার ১০ হাজার ৪৬৬ ভোট পেয়ে ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হন তিলোত্তমা সিকদার। তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। ২০১২-১৩ সেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিলোত্তমা। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয়তা কমে তার। এবং জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে তাকেও দেখা যায়নি কোথাও।

সাদ বিন কাদের চৌধুরী বিগত ডাকসুতে ১২ হাজার ১৮৭ ভোট পেয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। তিনি তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে ছিলেন।

১০৪ বছর বয়সী দেশের সবচেয়ে পুরানো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ তথা ডাকসু নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। এর মধ্যে ২৯ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে। আবার স্বাধীনতার ৫৩ বছরে হয়েছে ৮ বার। অথচ ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রতি বছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। শেষবার ২০১৯ সালের ডাকসুতে ২৫ টি পদের ২৩ টি পদই ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন  ছাত্রলীগের দখলে। ঢাবিতে আবারো দেখা দিয়েছে ডাকসুর আমেজ। কিন্তু এবার আর নেই ছাত্রলীগ। তাদের অধিকাংশ নেতাকর্মী আছেন পলাতক আথবা গ্রেপ্তারকৃত অবস্থায় জেলে

 

Link copied!