দেশ-জাতি-ধর্মের ব্যবধান ভুলে স্রোতের মতো এসে পড়েছে একটি গান-‘পাসুরি’। এই গানটি পাকিস্তানের জনপ্রিয় ‘কোক স্টুডিয়ো’র ১৪তম সিজনের নতুন সংযোজন।
'পাসুরি' বারো দিনে এগারো মিলিয়ন মানুষ তো দেখেছেই, রীতিমতো মহোৎসবই শুরু হয়েছে গানটিকে কেন্দ্র করে। বিখ্যাত মিউজিশিয়ান আলী শেঠী এবং নবাগত শিল্পী শে গিলের এই ডুয়েট গান এমনই শক্তিশালী আবহ তৈরী করেছে, এই 'পোলারাইজড ওয়ার্ল্ড' এর নানাবিধ গণ্ডিকে বিদীর্ণ করে জলোচ্ছ্বাসের মতই 'পাসুরি' ঢুকে যাচ্ছে নানা সংস্কৃতিতে, ভূগোলের নানা চলকে। গানের রিদম ও কম্পোজিশনই এমন, না চাইলেও খানিকটা নেচে উঠতেই হচ্ছে যেন আচমকা!
গানের ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করেন
খুব বেশিদিন আগের কথা না৷ সিংহলি ভাষায় গাওয়া 'মানিকে মাগে হিতে' সর্বগ্রাসী জনপ্রিয়তা পায়। গানের কথা বিন্দুমাত্র না বুঝেও শুধুমাত্র গানের সুরেই যেভাবে কাঁপলো গোটা বিশ্ব, তা বিস্ময়কর। এবার এই গানকেও টেক্কা দিতে চলেছে পাসুরি।
ভারতের সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আলি শেঠি এবং শে গিলের গাওয়া কেবল কণ্ঠের জাদু কিংবা বাণীর মাদকতা নয়, গানের ভিডিয়োটিও অজস্র মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। সব থেকে আশ্চর্য, পাকিস্তানি গানটি সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে ভারতে। বহু মানুষ এই গানটি শুনেছেন, দেখেছেন ভিডিয়োটি। কেউ কাঁদছেন, কেউ হাসছেন। যেন কোটি কোটি মানবহৃদয়কে সভ্যতার খোলস ছাড়িয়ে শৈশবে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে ‘পাসুরি’।
গানটি সম্পর্কে সুরকার শান্তনু মৈত্র বললেন, ‘‘অবিশ্বাস্য! এতটা ভাবিনি।’’ পাকিস্তানি নির্মাতারাও অবাক। ভাবেননি ভারত থেকেই এতখানি জনপ্রিয়তা পাবে তাঁদের সৃষ্টি। কিন্তু কী আছে এই গানে? খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই প্রথম নয়। পাকিস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে জীবনমুখী গান, কাওয়ালি, সুফি সঙ্গীত, এমনকি বহু ব্যান্ডের গানেরও ভক্তসংখ্যা ভারত আর বাংলাদেশেই বেশি। গুলাম আলি কিংবা আবিদা পারভিনকে না হলে এ ভাবে নিজের করে নেন ভারতীয়রা? সেই সেতু আজও বাঁধা হৃদয় থেকে হৃদয়ে।
কয়েক বছর আগেও ভারত-পাকিস্তান সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বজায় রেখেছিল। ছবি এবং গান তৈরির সময় কত শিল্পী পাকিস্তান থেকে এ দেশে এসে কাজ করেছেন, এখানকার শিল্পী গিয়েছেন ও দেশে। কিন্তু কালক্রমে রাজনৈতিক বৈরিতা সংস্কৃতির উপরও থাবা বসায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আতিফ আসলাম আর ভারতীয় অ্যালবামে গান না। বলিউডে পাকিস্তানি অভিনেতাদের প্রবেশ নিষেধ। পাকিস্তানেও ভারতীয় ছবি মুক্তি পায় না।তবে আশির দশকে পাকিস্তানি সঙ্গীতশিল্পী রোহেল হায়াৎ যে উন্মাদনা নিয়ে ‘কোক স্টুডিয়ো পাকিস্তান’ গড়েছিলেন, আজও সে টুকু ধরে রাখতে পেরেছেন। পশ্চিমী পপ জ্যামিং দিয়ে শুরু করে পাকিস্তানের নিজস্ব কাওয়ালিতে পৌঁছনো দীর্ঘ পথ। তত দিনে ভারতও তার নিজস্ব ‘কোক স্টুডিয়ো ইন্ডিয়া’ শাখা খুলে উন্মাদনার স্রোতকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানি ব্যান্ডের আদলে সঙ্গীত আবহ তৈরি হচ্ছে এ দেশে। কিন্তু রাজনৈতিক বাতাবরণে সে সব আর স্বীকার করে নেওয়ারও অবকাশ নেই।
তবে নেট দুনিয়ায় এক বার কিছু প্রকাশ্যে এলে তাকে আটকায় কার সাধ্য! সীমান্ত পেরোতে অসুবিধে হয়নি তাই ‘পাসুরি’র ।আসলে সঙ্গীত যে প্রাণের নির্যাস। রাজনৈতিক ক্ষত বোঝে না। ধর্মীয় হানাহানির পরোয়া করে না। ‘পাসুরি’-র মতো এক প্লাবন এসে আরও এক বার সদর্পে তা বুঝিয়ে দিয়ে গেল।
প্রখ্যাত লেবানিজ-আমেরিকান সাহিত্যিক খলিল জিবরান বলেছিলেন-সঙ্গীত আর কিছুই না, সঙ্গীত স্রেফ আত্মার ভাষা৷
'পাসুরি' যেন সে বাক্যকেই সমর্থন করে পুরোমাত্রায়। আলী শেঠী যেমন চেয়েছিলেন- এ গান স্পর্শ করুক সবাইকে। চেয়েছিলেন- বিভেদের পৃথিবীতে অন্তত একটি গানের নাতিদীর্ঘ সময়ের সঞ্জীবনীসুধা গণমানুষের যাপিত ক্ষোভ ভুলিয়ে দিক। ঠিক সেটাতেই যেন রূপান্তরিত হচ্ছে 'পাসুরি।
সূত্র: আনন্দবাজার, সিনেগল্পডটকম।