মাসুম আজিজ: উড়েই গেল বকপক্ষী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ১৭, ২০২২, ০৮:৪৪ পিএম

মাসুম আজিজ: উড়েই গেল বকপক্ষী

হারমোনিয়ামে আগুন লাগিয়ে দিলেন বাতাকান্দি গ্রামের মজিদ মিয়া বয়াতী। গানের দল ভেঙে দেবেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’র শুরুটা এমনই। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ কিছু ঘটনার মাঝেও অসাধারণত্ব দেখানো এই জনপ্রিয় নাটকের মজিদ মিয়া জীবনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের লড়াই শেষে আজ বকপক্ষীর মতো উড়ে গেলেন পৃথিবীর দৃশ্যপট থেকে। বলছিলাম মজিদ মিয়া চরিত্রে অভিনয় করা দেশবরেণ্য অভিনেতা মাসুম আজিজের কথা।

১৯৫৩ সালে পাবনায় জন্ম নেয়া এই শিল্পী ক্যানসারের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যায়ও ভুগছিলেন। ২০১৭ সালে তাঁর হার্টে চারটি ব্লক ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে ‘লাইফ সাপোর্টে’নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে আজ সোমবার দুপুরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

মাসুম আজিজ, অভিনয় যাঁর জন্য ছিল সবকিছু। অভিনয় নিয়ে তিনি সংবাদ মাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অভিনয় আমার সাধনা। শিল্প মানেই সাধনা। শিল্প মানেই ভালোবাসা। শিল্পের পথ কখনো সহজ হয় না, এখানে সাধনা করতে হয়। সাধনা ছাড়া শিল্পচর্চা হয় না।

৪০ বছর ধরে অভিনয়কে আপন করেই সবার কাছে এক নামে পরিচিত এই শিল্পীর কাছে জীবনের সবকিছুর আগে প্রাধান্য পেয়েছে অভিনয়। জীবনে অনেক প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও অভিনয়কে আঁকড়ে থাকা দেশবরেণ্য এ অভিনয়শিল্পীর ভাষায়, আমার স্ট্রাগল কারও অজানা নয়। জীবনের সব সুখ-আনন্দ বাদ দিয়ে থিয়েটার করেছি, নাটক করেছি। অভিনয়ে বিরতি দেইনি।

ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের পোকা মাথায় বয়ে বেড়ানো এই অভিনেতা ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অভিনয় শুরু করেন থিয়েটারে। মঞ্চ আর থিয়েটারে অভিনয়ের পাশাপাশি মাসুম আজিজ ছিলেন নাট্য নির্মাতাও।

১৯৮৫ সালে ‘প্রাচী’ নাটকের মধ্য দিয়ে টিভি নাটকে যাত্রা শুরু করে চার শতাধিক নাটকে অভিনয় করেন তিনি। তিন গ্যাদা, সাকিন সারিসুরি, দুই দুকুনে চার, উড়ে যায় বকপক্ষী, প্রিয় প্রতিপক্ষ- এই নাটকগুলোতে তাঁর অভিনয় মন কেড়েছিল সবার।

২০০০ সালে ‘একজন আয়নাল লস্কর’ নাটকে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে মেরিল প্রথম আলো সমালোচনা পুরস্কার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পেয়েছিলেন তিনি।

টিভি পর্দার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায়ও অনেকবার দেখা গিয়েছে তাঁর অভিনয়। মাসুম আজিজ অভিনীত কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো- মমতাজ, ঘানি, গহীনে শব্দ, বস্তির ছেলে কোটিপতি, গেরিলা, এই তো প্রেম, গাড়িওয়ালা ইত্যাদি।

২০০৬ সালে ঘানি চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে রাইসুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে যুগ্মভাবে পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০১১ সালে ‘গহীনে শব্দ’ চলচ্চিত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাইলেন্ট রিভার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার দেয়া হয়।

শুধু অভিনয় নয়, পাশাপাশি চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজও করেছেন তিনি। সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘সনাতন গল্প’ পরিচালনা করেন তিনি। সিনেমাটি ২০১৮ সালে মুক্তি পায়।

শিল্পকলার অভিনয় শাখায় তাঁর এই বিশেষ অবদানের জন্য চলতি বছর একুশে পদক পুরস্কার লাভ করেন মাসুম আজিজ। একুশে পদক পাওয়ার খুশিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার শুধু কান্না আসছে। রাষ্ট্র যখন নিজ থেকে আমাকে এটা দিচ্ছে, তা আমার জন্য অনেক বিশেষ। কতটা বিশেষ, এটা বলে বোঝাতে পারব না।’

ক্যানসারের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে লড়াই করে জীবন যুদ্ধে হেরে গেলেও মৃত্যুর আগেই পেয়েছিলেন কাজের স্বীকৃতি। তাঁর অভিনয়শৈলীর কারণে বহুদিন তাঁকে মনে রাখবে এদেশের অগণিত দর্শক। পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলে এই বকপক্ষী বাসা বেঁধে থাকবেন দর্শকদের মনের ভেতর।

Link copied!