কৃষি ঋণ বাড়িয়ে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২০, ২০২২, ০৬:২৫ এএম

কৃষি ঋণ বাড়িয়ে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কড়া নাড়ছে মন্দা। মন্দা থেকে সৃষ্টি হতে পারে দুর্ভিক্ষ। বৈশ্বিক এই সংকটের মধ্যে দেশে কৃষি ঋণ বেগবান করার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবছরই এই খাতে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও চলতি অর্থবছরে বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ (এফএও) দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী বছর দেশে খাদ্য ঘাটতি নিয়ে সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবিলার ওপর জোর দিতে হবে।

কৃষি ঋণে ভারতের মডেল

দেশে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে হারে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়ছে না। এর পেছনে বড় একটি কারণ হিসেবে খাতটির অপ্রতুল ঋণপ্রবাহের সমস্যাকে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির ইতিবাচক অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে। যার ফলে কৃষি ঋণ বিতরণ ভারতের মডেলকে অনুসরণ করারও তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনসের (আইসিআরআইইআর) এক গবেষণা মতে, ভারতে কৃষি ঋণের প্রবাহ প্রতি ১ শতাংশ বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি খাতের মোট জিডিপি বেড়েছে প্রায় দশমিক ৩ শতাংশ।

তবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা ধরে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সরাসরি কৃষকরা যেন সাহায্য পায়, তা নিয়ে এখনও কাজ করছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কৃষকরা ব্যাংকের কাগজপত্র ইত্যাদি জমা দিয়ে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী থাকে না। তাই তাঁদের কাছে ঋণ পৌছাতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বর্তমানে ইউনিয়ন পর্যায়ে এজেন্ট ব্যাংকের শাখা ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করলে তাঁদের এজেন্টের মাধ্যমে কৃষকের হাতে ঋণের টাকা পৌঁছে দিতে পারে। একইভাবে পাড়ায়-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে মোবাইল ব্যাংকিং হচ্ছে। এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও ব্যাংকগুলো কৃষকদের ঋণ দিতে পারে।

কৃষিঋণ পরিশোধের অবস্থান ভাল

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিতরণকৃত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বরাবরই কৃষির অবস্থান সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছিল ২২ হাজার ৭৪৯ কোটি ৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ২১ হাজার ২৪৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। পরের ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার মধ্যেও কৃষকদের কাছ থেকে বিতরণকৃতের চেয়েও বেশি অর্থ ফেরত পেয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ওই সময় কৃষি খাতে ২৫ হাজার ৫১১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ হলেও আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ১২৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সর্বশেষ গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি ২১ লাখ টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

ঋণ আদায় পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো হলেও কৃষি খাতে ঋণের সম্প্রসারণ হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরে দেশে কৃষি খাতে মোট জিডিপির পরিমাণ ছিল (চলতি মূল্যে) ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সে হিসেবে এ সময় কৃষি খাতে জিডিপির বিপরীতে ঋণ বিতরণের হার ছিল ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগের দুই অর্থবছরে এ হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ২১ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

এনজিওর মাধ্যমে ঋণ নিচ্ছে কৃষক

সরাসরি কৃষকের হাতে টাকা পৌঁছানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এনজিও’র মাধ্যমে ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণ বিতরণ করছে। এর ফলে কৃষক ঋণ পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অতিরিক্ত সুদ গুনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে। অবশ্য মাত্র ২৬ শতাংশ কৃষক ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ পাচ্ছেন। আর বাকি ৬৩ শতাংশ কৃষককে ব্যাংকের ঋণ পেতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) শরণাপন্ন হতে হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের অর্থনীতির অধ্যাপক ও উন্নয়ন অন্বেষণের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের কৃষি ঋণের হার অনেক কম। ভর্তুকির হারও কম। আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা। কারণ বাংলাদেশে উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও আমদানিনির্ভরতা রয়েই গেছে। তাই সরাসরি কৃষকরা যেন ঋণ পায় সেজন্য কৃষি ঋণ মেলা করার পাশাপাশি ভিন্ন চিন্তা করতে হবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

ছাড় পেয়েও ঋণ পরিশোধ করে কৃষকরা

২০২১ ও ২০২২ সালজুড়ে করোনার কারণে ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতায় ছাড় দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতি ছাড় বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তারা। মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বড় অংশও এ সুযোগ নিয়েছেন। তবে ছাড় পেয়েও কিস্তি পরিশোধ থেকে বিরত থাকেননি কৃষকরা। মহামারীকালে আনুপাতিক হারে তারাই সবচেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করেছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের তুলনায় আদায়ের অনুপাত ছিল ১০৬ শতাংশেরও বেশি।

ভাল গ্রাহক হলেও ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের ভাল বিতরণ করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ৪ শতাংশ সুদের এ ঋণ কর্মসূচির আকার দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০৭ কোটি টাকায়, যা দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত কৃষি ঋণের দশমিক ৪৭ শতাংশেরও কম। অথচ রেয়াতি সুদে বিতরণকৃত ঋণ আদায়ের হার ৯৩ শতাংশ। কেবল ৭ শতাংশ কৃষক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে গবেষণাপত্রে বলা হয়, রেয়াতি সুদে নেওয়া ঋণের অর্থ কৃষকরা শস্য উৎপাদনে ব্যয় করছেন। পরবর্তী সময়ে উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে যে মুনাফা হচ্ছে, সেটি থেকেই ঋণের অর্থ পরিশোধ করছেন কৃষকরা। যদিও প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কৃষক মনে করছেন, বিশেষ এ তহবিল থেকে দেয়া ঋণ লক্ষ্যমাফিক শস্য উৎপাদনে যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের কৃষকদের ১০ টাকার বিশেষ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৮ লাখ ২০ হাজার ৬৯৯। বিপুল এ ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয় আছে মাত্র ৫৬৯ কোটি টাকার আমানত। সে হিসাবে দেশের কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫৮০ টাকারও কম। লেনদেন না থাকায় এসব ব্যাংক হিসাবের বেশির ভাগই সক্রিয় নেই। তবে ব্যাংক হিসাবের একটি অংশ সরকারি ভর্তুকি ও পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। রেমিট্যান্স গ্রহণের মাধ্যমেও সক্রিয় আছে কৃষকদের অল্প কিছু ব্যাংক হিসাব।

Link copied!