স্বজনবৃক্ষ অলৌকিক সজনে গাছ

লাইফস্টাইল ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২১, ০৮:৫৬ পিএম

স্বজনবৃক্ষ অলৌকিক সজনে গাছ

স্বজন গাছ সজনে। সজনে ডাটা ও এর পাতা— দুটোই পুষ্টিগুণে ভরপুর। ইংরেজিতে গাছটিকে মিরাকল ট্রি বা অলৌকিক গাছ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম মরিংগা ওলেইফেরা (Moringa Oleifera)। 

এই গাছের প্রতি গ্রাম পাতায় গাজরের চারগুন বেশি ভিটামিন-এ, দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে তিন গুণ বেশি পটাসিয়াম, কমলালেবুর চেয়ে সাতগুণ বেশি ভিটামিন, দইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি প্রোটিন আছে।

Image result for moringa

চার হাজার বছর ধরে রন্ধন এবং নানা চিকিৎসায় এ গাছের ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রায় ৩০০ রকমের অসুখের চিকিৎসা হয় এই গাছ দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় বহু বছর ধরে বাড়ির আনাচে-কানাচে, বনে-জঙ্গলে, পুকুরের ধারে এই গাছ দেখা যায়। সম্প্রতি সেনেগাল, মালির মতো আফ্রিকান দেশগুলোতে এর চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। চাষও খুব সহজ। গাছের একটা ডাল পুতে দিলেই হলো। এই গাছ বাড়েও খুব দ্রুত। দুই তিন বছরে ফুল দেয়। এর ফুল, পাতা, ফল সব কিছুই সুস্বাদু।এতক্ষণ যে বিস্ময়গাছটির গুণগান করা হলো তার বাংলা নামটা চেনেন না, এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। চেনা জিনিসের মূল্য হয়তো আমরা কম দেই, কিন্তু সারা বিশ্বই আজ এই গাছ নিয়ে গবেষণা করছে, এই গাছের জয় জয়কার চারদিকে। এই বিস্ময়বৃক্ষটি আমাদের সবার পরিচিত সজিনা বা সজনে গাছ।

আমরা হয়তো কম-বেশি সবাই সজিনার ডাল বা তরকারি খেয়েছি। কিন্তু সজনে পাতাও যে শাক হিসেবে খাওয়া যায়, এটা সবাই জানি না। তেল-রসুন দিয়ে রান্না সজিনে খেতে শুধু সুস্বাদুই নয়, পুষ্টিকরও। সজিনা পাতা ও সজিনাতে প্রচুর আঁশ আছে, যা খাদ্যনালী ও অন্ত্রের পরিপাক তন্ত্রকে পরিষ্কার করে। বিশেষ করে তৈলাক্ত অনেক খাবার আমরা খাই, যার তেল রক্তনালীতে আটকে থাকে। সেগুলো বের করতে সজিনা সাহায্য করে। সজিনার মধ্যে আইসোথিয়োকাইনেটস নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, যা গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং গ্যাস্ট্রিকজনিত ক্যানসার ঠেকাতে সহায়তা করে।

Image result for moringa

পানি বিশুদ্ধ করতে আমরা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম নানা পদ্ধতি ব্যবহার করি। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সজিনার দানা পানি বিশুদ্ধকরণে সবচেয়ে ভালো প্রাকৃতিক উপায়। উপস্যুলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা সন্দর্ভে বলা হয়েছে, সজিনার দানা পানি দূষণ রোধ করে, পানিতে কোনো রকম দূষণীয় ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো অণুজীব উপদান দ্রবীভূত হতে দেয় না। আমেরিকা, নামিবিয়া, ফ্রান্স ও বতসোয়ানার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সজিনার আণবিক্ষণিক প্রোটিন উপাদান পানি বিশুদ্ধকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। একইভাবে সজিনা শরীরকে বিশুদ্ধ রাখে। সজিনাকে আজকের বিশ্বে ‘সুপার ফুড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

এই সুপার ফুডের অন্তত ছয়টি গুণ আছে, যা একে তারকাখ্যাতি দিয়েছে

পুষ্টির ভান্ডার

লেখার শুরুতেই সজিনার পুষ্টি গুণের কথা বলা হয়েছে। প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি এতে আয়রনও আছে। আয়রনের দিক থেকে এটি পালং শাকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি শক্তিশালী।

এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি

সজিনার পাতাকে এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি বলা যায়। এর মধ্যে ভিটামিন সি, বেটা-কেরোটিন, কিউরেকটিন এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড বিদ্যমান। উল্লেখ্য, এসব উপাদানই মানবদেহের জন্য উপকারী। বিশেষ করে, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড রক্তের চাপ ও শর্করা কমাতে বিশেষ কাজে দেয়। এশিয়ান প্যাসিফিক জার্নাল অব ক্যানসার প্রিভেনশন দারি করছে, সজিনার পাতায় বিদ্যমান এন্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার কোষ সৃষ্টিতে বাধা দেয়।

ডায়েবেটিস প্রতিরোধক

এন্টি-অক্সিডেন্ট এবং আইসোথিয়োকাইনেটস নামের উপাদানগুলো নিয়মিত গ্রহণে ডায়েবেটিস কমে যায়। প্রতিদিন মাত্র ৫০ গ্রাম সজিনার পাতা খেয়ে ডায়বেটিস ২১ শতাংশ হ্রাস পায়। তিন মাস এক চা চামচ করে সজিনার পাতার গুড়া খেয়ে ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

বীজের তেলেসমাতি!

সজিনার বীজের তৈরি তেলে সত্যিই তেলেসমাতি আছে। অন্য যেকোনো ভেজিটেবেল অয়েল-এর চেয়ে এর গুণাগুণ বেশি। দীর্ঘদিনের লিভারের রোগীর জন্য এ তেল খুব উপকারী। সজিনা গ্রহণে খাদ্যের গুণগত মান অটুট থাকে। পচনশীল খাবারকে দীর্ঘস্থায়ীত্ব দিতেও সজিনার তেলের তুলনা নেই। বাতের ব্যথা-বেদনায় যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি শীতের আর্দ্রতা থেকে ত্বককে রক্ষা করা, রূপচর্চাতেও এই তেল কাজে লাগে।

কোলেস্টেরল কিলার

ঘাতক কোলেস্টেরলকে হত্যা করে সজিনা আপনার হৃদপিন্ডের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। থাইল্যান্ডে বহু বছর ধরে সজিনাকে হৃদরোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ৩ মাসের ব্যবহারে এটি কোলেস্টেরল লেভেল অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারে।

আর্সেনিক দূষণ রোধ

পানিতে আর্সেনিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা নিরোধে সজিনার বীজ কিংবা পাতা ভূমিকা রাখে। এমনকি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করতে সজিনা বীজ বা পাতা ব্যবহার কার্যকরী।

Image result for moringa

এছাড়া ক্যান্সাররোধী ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে দারুন কাজে দেয় সজনে শাক ও ডাটা। এত উপকারী এবং সহজে প্রাপ্য সজিনার ব্যবহার এখনো আমাদের কাছে সীমিত পরিসরেই রয়ে গেছে। সজিনার ডাল আর তরকারির পাশাপাশি খুব সহজেই এর কচিপাতা শাক হিসেবে খাওয়া যায়। পালং, মূলা শাকের মতোই এটিকে রান্না করা যায়। এমনকি সালাদে টমেটো, শসার সঙ্গে সজনে পাতা ব্যবহার করা যায়। যেকোনো স্যুপেও কয়েকটি সজিনা পাতা বাড়তি স্বাদ আর পুষ্টি এনে দেবে। পাতা গুঁড়া বা বীজের তেল অবশ্য আমাদের দেশে সেভাবে ব্যবহৃত হয় না। সজিনার তেল অবশ্য বেশ দামি, অলিভ অয়েলের চেয়েও। আমরা চাইলে সজিনার তেল ও গুঁড়াকে বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করার কথা ভাবতে পারি। ইউনানী ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বহু বছর ধরেই এর ব্যবহার চলে আসছে। আমরা নতুন করে এই সুপার ফুড আর বিস্ময়কর বৃক্ষের কথা ভাবতে পারি।

সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে

Link copied!