স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে রোজার প্রথম কয়েকদিন খেয়াল রাখতে হবে যে বিষয়গুলো

বিবিসি বাংলা

মার্চ ২৪, ২০২৩, ০৭:৩৯ পিএম

স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে রোজার প্রথম কয়েকদিন খেয়াল রাখতে হবে যে বিষয়গুলো

শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে ইসলামের পবিত্র রমজান মাস। অনেকেই এ মাসে চিন্তিত থাকেন যে এই মাসে কীভাবে শরীরের পুষ্টির সাথে প্রতিদিনের ব্যায়ামের ভারসাম্য রাখবেন।

রোজার সময় সারাদিন না খেয়ে থেকে ব্যায়াম করতে চাইলে কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।

শরীরচর্চা প্রশিক্ষক বেলাল হাফিজ ও পুষ্টিবিদ নাজিমা কুরেশি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। যুক্তরাজ্যে ‘দ্য হেলদি মুসলিমস’ হিসেবে পরিচিত এই দম্পতি রোজা রেখে ব্যায়াম করার বিষয়ে ‘দ্য হেলদি রামাদন গাইড’ নামে একটি বইও লিখেছেন।

“রোজার উদ্দেশ্য হল প্রার্থনা, আধ্যাত্মিকতা ও আত্মিক উন্নতি সাধনের দিকে মনোযোগ দেয়া – এবং এই মাসের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখা। আমরা যা খাই এবং যেভাবে ব্যায়াম করি, তা এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে বড় ভূমিকা রাখে। কারণ আমাদের খাদ্য ও ব্যায়াম আমাদের মানসিক চাপের মাত্রা, জীবিকা ও জীবনযাপনের ভারসাম্য ও পরিবারে বড় ধরণের প্রভাব তৈরি করেন”, বলেন হাফিজ।

আপনি যদি ৩০ দিন রোজা রেখে স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি আপনার ফিটনেসও অক্ষুণ্ণ রাখতে চান, তাহলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন।

পর্যাপ্ত পানি পান করা

“অনেক মানুষই অভিযোগ করেন যে রোজার প্রথম কয়েকদিন তারা মাথা ব্যাথায় ভোগেন। এটি সাধারণত পানিশূণ্যতার কারণে হয়ে থাকে”, বলছিলেন কোরেশি।

“লক্ষ্য হল, স্বাভাবিক সময়ে আমরা যেই পরিমাণ পানি পান করে থাকি, রোজার সময় একই পরিমাণ পানি সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত পান করা। অর্থাৎ, ঐ সময়ের মধ্যে কিছুক্ষণ পরপর অল্প অল্প পানি পান করা যেতে পারে।”

এছাড়া, আপনি যদি ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় খেয়ে অভ্যস্ত থাকেন, তাহলেও রোজার প্রথম কয়েকদিন আপনার মাথা ব্যাথা হতে পারে। কারণ ক্যাফেইনের অভ্যাস থাকা ব্যক্তিদের শরীরে ক্যাফেইনের ঘাটতি হলে মাথা ব্যাথা তৈরি হয়।

দিনের প্রথম খাবার পুষ্টিকর রাখুন

হাফিজের ভাষ্য অনুযায়ী, “দিনে যেহেতু তিনবারের বদলে দুইবার খাবার গ্রহণ করবেন আপনি, আপনার ঐ দুইটি মিল যেন আপনাকে সারাদিনের চালিকাশক্তি দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে আপনার।”

“মানুষ অনেক সময় মনে করে, তারা যেহেতু দুর্বল অনুভব করছে তাই ভোররাতে সেহেরি না খেয়েই রোজা রাখবে। কিন্তু এরকম ক্ষেত্রে শরীরে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হয়।”

“আপনার ভোররাতের খাবারে প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বিজাতীয় খাবারের পাশাপাশি কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা-জাতীয় খাবার থাকা প্রয়োজন। সাথে যদি কিছু সবজি ও ফল থাকে তাহলে তা বোনাস।”

পুষ্টিবিদ নাজিম কোরেশি অবশ্য স্বীকার করেন যে যাদের অভ্যাস নেই তাদের জন্য এত সকালে খাওয়া অনেক সময় বেশ কষ্টকর হতে পারে। তবে তিনি বলেন যে আপনার শরীর দ্রুত এই অভ্যাসের সাথে মানিয়ে নিতে পারে।

“প্রথম কয়েকদিন যদি আপনার খুব ভোরে খেতে কষ্ট হয়, তাহলে শুরুতে কয়েক কামড় খাবেন। সাধারণত চতুর্থ বা পঞ্চম দিনের মধ্যে ব্যক্তির ঐ সময় খাবার গ্রহণের অভ্যাস হয়ে যায়।”

ইফতারে অতিরিক্ত খাবার না গ্রহণ করা

যেহেতু রোজার সময় আমরা সারাদিন না খেয়ে থাকি, ইফতারের সময় আমাদের অনেকেরই মনে হতে পারে যে সারাদিনের প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে অনেক খেতে হবে। বিশেষত বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে খাওয়ার সময় এই প্রবণতা আমাদের মধ্যে বেশি কাজ করে।

হাফিজ বলেন, “রোজা ভাঙা একটি আনন্দঘন মুহূর্ত, যখন মানুষ বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে খেতে বসে। কিন্তু ইফতারে আমরা অনেকেই যা খাই তা অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার হয়ে যায়।”

“যেমন ধরুন সিঙ্গারা বা সমুচা। সাধারণত একটি সিঙ্গারা বা সমুচায় ২০০ থেকে ২৫০ ক্যালরি থাকে। আর ইফতারে আমরা সাধারণত একটি সিঙ্গারা বা সমুচা খাই না। এভাবে হিসেব করলে দেখা যাবে যে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার আমরা ইফতারেই খেয়ে ফেলি।”

“যদি সপ্তাহে একদিন কিছুটা বেশি খাওয়া হয়, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু রমজান মাসে দেখা যায়, প্রতিদিনই আমরা অতিরিক্ত ইফতার খেয়ে ফেলি। তাই কার্যত সারাদিন না খেয়ে থাকলেও, দিন শেষে দেখা যায় আমরা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি খেয়ে ফেলছি।”

কোরেশির মতে, “অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে আপনি অনুভব করবেন যে আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল অনুভব করছেন এবং পরেরদিনের রোজার জন্য উৎসাহী অনুভব করছেন না।”

“আমরা বলি, আপনি পানি দিয়ে ইফতার শুরু করুন এবং এরপর খেজুর ও কিছু ফল খান। এরপর খাবার খওয়ার আগে প্রার্থনা শেষ করুন। খাওয়ার সময় আপনার ঐতিহ্যবাহী খাবারই খান, কিন্তু সেখানে যেন প্রোটিন কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট ও সবজি থাকে তা নিশ্চিত করুন। সেখানে সুপ, স্টু, মাছ বা মুরগির মাংসের আইটেম থাকতে পারে।”

খাওয়ার ভারসাম্য বজায় রাখুন

আপনি যদি কোনো দাওয়াতে বা পরিবারের সদস্যদের সাথে খেতে বসেন, তাহলে সব আইটেম খাওয়ার একটা চাপ অনেক সময় থেকে থাকে।

তবে কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে আপনি নিজের খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

হাফিজ বলেন, “আমরা সবাইকে বলি খাওয়ার সময় ধীরে খাওয়া শেষ করুন। সময় নিন, আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলুন। আপনি যদি কোনো দাওয়াতে গিয়ে তাকেন আর আপনার হোস্ট আপনার প্লেট খালি দেখে, তাহলে আপনাকে আবার খেতে বলতে পারে। সুতরাং খুব ধীরে নিজের খাবার শেষ করুন যেন আরো খাবার নিতে কেউ চাপ না দিতে পারে।”

আর কোনো দাওয়াতে যদি আপনাকে একটি ডিশ নিয়ে যেতে হয়, তাহলে স্বাস্থ্যকর খাবার নিয়ে যান।

এই বিষয়ে ঠাট্টা করে হাফিজ বলছিলেন, “আমরা ঐ দম্পতি যারা সালাদ নিয়ে যাই।”

“আমি জানি যে সবজি কখনোই জনপ্রিয় খাবার নয়। কিন্তু বাস্তবতা হল, টেবিলে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট থাকবেই। তাই সবজি জাতীয় খাবার নিলেই বরং খাবারের মেনুতে ভিন্নতা আসবে।”

ব্যায়ামের সময় নির্ধারণ করা

“অধিকাংশ মানুষই ইফতারের এক বা দুই ঘণ্টা আগে ব্যায়াম করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কারণ সেক্ষেত্রে ব্যায়াম শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা খাবার ও পানি পেতে পারে”, বলেন হাফিজ।

“তবে এই পদ্ধতি যদি আপনার সূচীর সাথে কাজ না করে, তাহলে আপনি আপনার নিজস্ব সূচী অনুযায়ী চলতে পারেন।”

“গত বছর আমি রোজা রেখে দুপুরের পরপর ব্যায়াম করতাম – আর সেসময় আমি লক্ষ্য করি যে দিনের বাকি সময় আমার শক্তির মাত্রা আকাশছোঁয়া ছিল। শুরুর পর প্রথম ব্যায়াম কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের শরীর খুব দ্রুত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারে।”

শক্তি ও স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দিন

দিনের যেই সময়েই আপনি ব্যায়াম করেন না কেন, আপনার কার্যক্রমের সাথে মানিয়ে নেয়াটা জরুরি।

হাফিজ বলেন, “রোজার সময় ব্যায়ামের তীব্রতা কমিয়ে ফেলুন। এই মাসে আপনার শরীরের শক্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, নাড়াচাড়া ও গতিশীলতা বাড়ানোর দিকে নজর দিন। শারীরিকভাবে আগের চেয়ে কার্যকর হওয়ার পেছনে মনোযোগ দিন।”

“একটি তীর ও ধনুকের কথা চিন্তা করুন। রমজান মাসে আপনি যেটা করছেন, তা হল ধনুকটি টেনে তীরকে পেছনে নিয়ে আসছেন। আপনি যখন ৩০ দিন ধরে শক্ত একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করতে পারবেন, এরপর আপনি দেখবেন যে তীর, বা আপনার শরীর, কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে।”

আপনার যখন নিয়মিত কোনো ব্যায়ামের রুটিন নেই এবং আপনি শুধু আপনার ফিটনেস বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, তখন এই কম তীব্রতার ব্যায়ামগুলো আপনার জন্য বেশি কার্যকর হতে পারে।

হাফিজের মতে, এই মাসে কঠিন ধরণের ব্যায়ামের রুটিন শুরু না করে হাঁটা বা হালকা দৌড়ানোর মত ব্যায়াম করা বেশি কার্যকর।

আপনি কী চান তা মাথায় রাখুন

হাফিজ মনে করেন রমজান মাসে রোজা রেখে ব্যায়াম করতে গিয়ে যদি শারীরিকভাবে সমস্যা হয়, তাহলে রোজা বা না খেয়ে থাকার উদ্দেশ্যের বিষয়ে চিন্তা করা উচিৎ।

“শুধু না খেয়ে থাকার জন্য না খেয়ে থাকার চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে এই মাস। এই মাসের এক ধরণের আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। আমাদের ঐতিহ্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের বিষয়ও রয়েছে।”

“এর জন্য কিছুটা কঠোরতা প্রয়োজন – যা আমাদের শক্তিশালী করতে ও আত্মিক উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করে। যখন আপনি রোজা রেখে ব্যায়াম করতে গিয়ে দুর্বলতা অনুভব করবেন, তখন নিজেকে বোঝান যে এটা স্বাভাবিক, এটি স্রেফ ৩০ দিনের জন্য। এই ধরণের ভাবনা আমার ক্ষেত্রে আরো বেশি সহনশীলতা তৈরি করে।”

Link copied!