এপ্রিল ১২, ২০২৩, ০২:০২ এএম
মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় ওষুধ নীতির রূপকার, সমাজকর্মী, সমাজে সেবক, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের রাজপথ কাঁপানো সাবেক ছাত্রনেতাসহ অনেক বিশেষণে ভূষিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন কিডনিরোগসহ বিবিধ স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী নারীনেত্রী শিরীন হক এবং দুই সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিনী।
জাফরুল্লাহর বাবার শিক্ষক ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন। ১০ ভাইবোনের সবার বড় জাফরুল্লাহ পুরান ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন শেষ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে এমবিবিএস শেষ করার পর ১৯৬৭ সালে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান
এফআরসিএস চূড়ান্ত পর্ব শেষ না হতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তখনই তিনি দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে দেশের টানে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নেন। পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করে ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লিগামী প্লেনে চড়ে বসেন। পরে ওখান থেকে কলকাতা হয়ে আগরতলায় প্রশিক্ষণ নেন।
পাকিস্থানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে লন্ডনের হাইডপার্কে যে কয়জন বাঙ্গালী পাসপোর্ট ছিড়ে আগুন ধরিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিল তাদের একজন ড. জাফরুল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তার জন্য বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাছ থেকে ১০ লাখ পাউন্ড চাঁদা যোগাড় করেছিলেন। ওই প্রচেষ্টায় ডা, জাফরুল্লাহর অবদানও কম নয়।
আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য ড. জাফরুল্লাহ সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের সহযোগিতায় আগরতলার বিশ্রামঘরের মেলাঘরে গড়ে তুলেছিলেন ৪৮০ শয্যা বিশিষ্ট প্রথম ফিল্ড হসপিটাল " বাংলাদেশ হসপিটাল"। ডা. এম এ মবিনের সাথে যৌথভাবে তিনি এই হাসপাতাল পরিচালনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি অল্পসময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেন। পরবর্তীতে ওইসব নারী রোগীদের সেবা করতেন। জাফরুল্লাহর এই সেবাপদ্ধতির বিষয়টি বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’ এ প্রকাশিত হয়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. জাফরুল্লাহ গ্রামে গিয়ে শুরু করেন স্বাস্থ্যযুদ্ধ। ফিল্ড হাসপাতালটিকেই কুমিল্লাতে স্বাধীন দেশের প্রথম হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তুলেন। পরবর্তীতে রাজধানীর ইস্কাটনে হাসপাতালটি পুনঃস্থাপিত হয়। পরে হাসপাতালটিকে রাজধানীর অদূরে সাভারে " গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র" নামে স্থানান্তর করা হয়। "গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র" নামটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নামকরণ করেন। শুধু তাই নয়, সাভারে হাসপাতালটির জন্য তিনি ৩১ একর জমিও বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
রাজনীতি বিমুখ প্রাণপুরুষ
জাফরুল্লাহ ছিলেন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের একনিষ্ট সমর্থক। ইচ্ছে করলে তিনি বড় মাপের রাজনীতিক হতে পারতেন। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীত্বের লোভ এড়িয়ে গেছেন সযত্নে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যেসব অরাজনৈতিক ও সামরিক সরকার দেশে ক্ষমতায় ছিল তারা সবাই জাফরুল্লাহকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও তিনি তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের দেয়া মন্ত্রীত্বের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ৪ পৃষ্ঠার একটি চিঠির মাধ্যমে। আবার এরশাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দেন। তবে জাফরুল্লাহর পরামর্শেই এরশাদ আমলে পোস্টার, বিলবোর্ড বাংলায় লেখা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, উপজেলা শাসন ব্যবস্থা ও সফল জাতীয় ঔষুধনীতি ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি হয়েছিল।
১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার সময় লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ওই সময় ব্রিটিশ সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন- ‘তিনি(বঙ্গবন্ধু) নিজের রক্ত দিয়ে জাতির ঋণ পরিশোধ করে গেলেন।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পর তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষুধ নীতি। এরশাদের সময় তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও অসম্ভব একটি ভাল কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যখাতে যেটাকে বিবেচনা করা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে। তাঁর প্রচেষ্টায় আমদানি ওষুধের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫-এ। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে এই মানুষটির অবদান বিশাল।
পুরষ্কার ও সম্মামনা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রামন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫), সুইডেন থেকে রাইট লাভলিহুড (১৯৯২) পুরষ্কার লাভ করেন। এই পুরষ্কার বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত। ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনালহেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২১ সালে পান আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার।
অন্যান্য ভূমিকায় জাফরুল্লাহ
ভিন্ন ধাতুতে গড়া এক লড়াকু মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন গণমানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে। সাম্প্রতিক সময়েও তিনি অবস্থান নিয়েছেন কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনে।
বাস্তবজীবনে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ মহান চিকিৎসক যাপন করেছেন সাধারণ জীবন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জাফরুল্লাহ চৌধুরী মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন। তাই দাফনের জন্যও প্রয়োজন হবে না তাঁর কোন জমির।