মে ১৫, ২০২২, ০৩:৫০ এএম
দেশে সাংবাদিকরাই এখন সাংবাদিকদের শত্রু। আমি কিছু লিখলাম, সেটি গিয়ে অন্যত্র গিয়ে বলবে যে আমি লিখেছি। আমরা বিপজ্জনক অবস্থায় আছি। আজকে ভয় আগুনের মতো। বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না। লিখলেই মনে হয় বিপদ আসতে পারে। এই ভয় থেকে মুক্তি পেতে হলে সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।
‘ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় শনিবার মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এসব কথা বলেন।
সভায় বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক এবং সাংবাদিক নেতারাও বক্তব্য রাখেন। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে এদিন বিকেলে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ওই আলোচনা সভার আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ। ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস থাকলেও ওই সময় ঈদের ছুটি থাকায় এখন ওই দিবসের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে মিল রেখে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভা থেকে সাংবাদিকতার এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন আইনের প্রয়োগ ঘুরেফিরে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকতা পেশার বিকাশে সাংঘাতিক অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। সব মিলিয়ে এখন সাংবাদিকতা বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। শুধু আইনের অব্যবহারই নয়, এখন জাতীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিক থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়েও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণভাবে নজরদারি করা হচ্ছে।
সভাপতির বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘সমস্ত আইনের প্রয়োগ ঘুরেফিরে মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন হলো, স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে এত আইন কেন? সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এত আইন কেন? সাংবাদিকেরা কী করছেন, যার জন্য এত আইন দিয়ে হাত-পা বেঁধে দিতে হবে?’
সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, সংবাদপত্রের জগৎ আজ অনেকটা সংকুচিত। ছাপা কাগজের চাহিদা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ডিজিটাল বাস্তবতা বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের জন্য একদিকে যেমন অনেক সুযোগ এনে দিয়েছে, তেমনি সাংবাদিকদের জন্য অনেক ঝুঁকিও তৈরি করেছে। তাঁদের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে এ কে আজাদ বলেন, নোয়াব শুরু থেকেই এই আইনের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাঁরা মনে করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
সাংবাদিকতায় তিন ধরনের আইনি জটিলতার কথা তুলে ধরেন বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, প্রথমত আইন নেই। আরেকটি হচ্ছে পুরোনো আইন এবং একটি হচ্ছে নতুন আইন। আইন না থাকার ফলে যাঁরা টেলিভিশনে কাজ করেন, তাঁরা আইনগতভাবে সংবাদমাধ্যম কর্মী নন, তাঁরা কোম্পানির কর্মচারী। আরেকটি বিষয় হলো, পুরোনো আইন। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ১৯২৩ সালের পুরোনো আইন দিয়ে ধরা হলো। অর্থাৎ অতি পুরোনো আইন যখন যার সম্পর্কে প্রয়োজন হয়, তখন ব্যবহার হয়। আরেক বিপদ হলো, নতুন আইন। নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন আইন হবে। কিন্তু সেই আইনগুলো এমনভাবে করা হচ্ছে, আইন নিজেরাই সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে অথবা আইনের অপপ্রয়োগ আইনকে ভয়ংকর করে ফেলে।
বিএফইউজের একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক সাংবাদিকদের বিভাজনের প্রসঙ্গে বোঝাতে গিয়ে অনুষ্ঠানে বিএফইউজের নামে দুজন সভাপতির উপস্থিত থাকার উদাহরণ তুলে ধরেন। নবম ওয়েজ বোর্ডকে খণ্ডিত উল্লেখ করে এই সাংবাদিক নেতা বলেন, নবম ওয়েজ বোর্ড এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত হলে সাংবাদিকেরা আজ পর্যন্ত কমবেশি ৫৪০ কোটি টাকা মালিকদের কাছ থেকে পেতেন। তিনি এই পাওনা টাকা ফেরত এবং নবম ওয়েজ বোর্ড কার্যকর করার দাবি জানান।
বিএফইউজের আরেকাংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, প্রধান প্রধান পত্রিকা ও টেলিভিশন বিশেষ করে সংবাদপত্রের যাঁরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজরদারি চলছে। শুধু ঢাকার জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিক নন, জেলা পর্যায়েও যাঁরা প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা করেন, তাঁরাও নজরদারির মধ্যে আছেন।
সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের আরেকাংশের সাধারণ সম্পাদক আখতার হোসেনসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিক।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক।