জেলা পরিষদ একটি সংবিধিবদ্ধ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য এবং সংরক্ষিত আসনের ৫ জন নারী সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদ গঠিত। জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জেলা চেয়ারম্যান ও এর সদস্যদের কাজ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অনেক সদস্যের দাবি, চেয়ারম্যানের কাজ থাকলেও তাঁদের কোনো কাজ নেই। বছরে পরিষদের যে কয়টি মিটিং হয় সেখানে শুধু স্বাক্ষর দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। আবার অনেকে জেলা পরিষদকে সরকারী দলীয় বয়স্ক ও বঞ্চিত নেতাদের পূণর্বাসন প্রকল্প বলে মনে করেন।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) নবনির্বাচিত ৫৯ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ৬২৩ জন সদস্যও শপথ নেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ৬১টি জেলা পরিষদে ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব খাতের আওতায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা এবং এডিপি’র আওতায় ৫৪০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছি। তবে জেলা পরিষদের অনেক সদস্যই জানেন না তাঁদের কাজ সম্পর্কে।
জেলা পরিষদ আইনে কী আছে
জেলা পরিষদ আইনে পরিষদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। তবে পরিষদ সদস্যদের দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া নেই। জেলা পরিষদ আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০১৬) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণের জন্য আইনে বিধি প্রণয়নের বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করলেও দায়িত্ব-কর্তব্যের বিধি এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি।
জেলা পরিষদের কাজ কী
জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী, পরিষদ ১২টি বাধ্যতামূলক কাজ করবে। কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে, জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা; উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নেওয়া প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা; উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ।
এ ছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক কল্যাণসহ ৭টি ক্ষেত্রে ৬৮ ধরনের ঐচ্ছিক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
কাজ কী জানেন না অনেক সদস্য
ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের সদস্য (ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা থেকে) একরাম হোসেন বলেন, চেয়ারম্যানের নির্বাহী ক্ষমতা আছে। সদস্যদের কোনো ক্ষমতা নেই। উপজেলা পর্যায়ে জেলা পরিষদ সদস্যদের কেউ চেনেও না।’
গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য এস এম কামাল সিকদার সেলিম (কাশিয়ানী উপজেলা থেকে) এ বিষয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘সদ্য নির্বাচিত হয়েছি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ি কাজ সম্পর্কে বলা আছে। আশা করি কাজে সমস্যা হবে না ‘
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা পরিষদ নামে মাত্র কিছু কাজ করতে পারছে। একই কাজ করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরাও। ফলে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কিংবা সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের এ সব কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারেন না।
জেলা পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সদস্যরা শুধু এলাকায় ছোট আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশানের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার তালিকা প্রণয়নের কাজ করেছেন। চেয়ারম্যানের নির্বাহী ক্ষমতা থাকলেও সদস্যদের কোনো ক্ষমতা নেই।
গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চৌধুরী এমদাদুল হক পরিষদের কাজ সম্পর্কে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘কাজের ক্ষেত্রে সরকারকে কিছু বিধি তৈরি করতে হবে। আমাদের মর্যাদা ও ক্ষমতা ঠিক করে দিতে হবে। জেলার ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় আমাদের অবস্থান স্থানীয় সংসদ সদস্যেরে ওপরে না নিচে— তা-ও স্পষ্ট নয়। এই অস্পষ্টতা সরকারকে দূর করতে হবে।’
চৌধুরী এমদাদুল হক আরও বলেন, ‘জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের কাজ ভিন্ন। এমপিদের কাজ আইন প্রণয়ন করা। উপজেলা চেয়ারম্যানরা জেলা পরিষদের মেম্বার হবে। আর জেলা পরিষদ প্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। ডিসির কাজ হবে প্রশাসন চালানো। তবে এসব সুষ্পষ্ট করতে না পারলে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে।’
বিশেষজ্ঞরা কী বলেন?
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলররা এখনো জানেন না তাঁদের কাজটা কী। দায়িত্বের পরিধি নিয়েও আছেন নানা দ্বিধায়। অথচ এদের কাজ সুস্পষ্ট করা না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’
তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, ‘বর্তমান আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ চালাতে গেলে অবশ্যই জটিলতা সৃষ্টি হবে। এমতাবস্থায় নতুন করে বিধি তৈরি করে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরদের কাজ ভাগ করে দেওয়া সরকারের উচিত হবে।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের বেতন ৫৪ হাজার টাকা ও আপ্যায়ন ভাতা বাবদ মাসে আরো পাঁচ হাজার টাকা পান। জেলা পরিষদের সদস্যদের মাসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকা।
অভিযোগ আছে, জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের অনেকে কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন। তাঁদের বেতন বা সম্মানির যে কাঠামো তাতে একজন জেলা পরিষদ সদস্য কোনোভাবেই পাঁচ বছরে বেতন ভাতা থেকে তাঁর নির্বাচনী খরচ উঠাতে পারবেন না। তাহলে এত ব্যয় কেন? এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘নির্বাচনতো একটা উসিলা মাত্র। ক্ষমতাসীন দলের লোকদের অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা এটি। এ জন্য যে কোনো মূল্যে ভোট কেনেন তাঁরা। জয় পেলেই বিভিন্ন উৎস থেকে আবার আয়ের ধান্ধায় থাকেন।’
জেলা পরিষদের সমালোচনায় অনেকে মুখর । একে শাসক দলের বয়স্ক ও বঞ্চিত লোকদের পুনর্বাসন প্রকল্প বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। তাঁদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের জেলা শাখা কমিটিতে যেসব প্রবীণ নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদেরই পুনর্বাসনে এটি করা হয়েছে।
সুজন সম্পাদক এ বিষয়ে দ্য রিপোর্টকে আরও বলেন, ‘জেলা পরিষদ একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান। এটি আসলে ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র লিডারদের পুনর্বাসন প্রকল্প ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে আসলে জনসেবার তেমন কিছুই নেই। মূলত সিনিয়র নেতাদের জন্য একটা সন্মানজনক স্থানে বসাতেই এটি করা হয়েছে।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, 'আমি পুনর্বাসন' শব্দটা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছি না। এটা এক ধরনের পলিসি অব অ্যাকোমোডেশন অন দি পার্ট অব দি পলিটিক্যাল পার্টিজ। দলের ত্যাগী নেতাদের যাদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাঁদের কোথাও না কোথাও সম্মানজনক পদে স্থান দিতে হয়। তাই এটি করা হয়ে থাকতে পারে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরণের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁরা শুরুতে নানা প্রতিশ্রুতির বিষয়ে জানলেও পুরো পাঁচ বছরে কখনও তাঁর কোনো প্রতিফলন দেখতে পাননি। সংশ্নিষ্টদের অভিমত, দেশের সংবিধানে অন্তত চারটি অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারপরেও এটি একটি আলংকারিক স্তর হিসেবেই পুরো মেয়াদ পার করেছে। এবারের জেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিতরা কি সেই একই পথে হাঁটবেন? নাকি কোনো বদল আসবে এবার?