এপ্রিল ১, ২০২৫, ০৫:১২ পিএম
তারা দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ইসলামপন্থী উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যা দেশের দুর্বল গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এই কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন শহরে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ইসলামী আইনের কঠোর ব্যাখ্যা আরোপ করেছে। এক ক্ষেত্রে, তারা নারীদের ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ করেছে। অন্য একটি ঘটনায়, এক ব্যক্তি এক মহিলাকে ওড়না ঠিক করা কিংবা হিজাব না পরার কারণে হয়রানি করলে তাকে আটক করে। পরবর্তীতে পুলিশ তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং পরে আদালত প্রাঙ্গনে ফুলের মালা দিয়ে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
ইসলামী আইনের কঠোর প্রয়োগের দাবিও আর জোরালো হয়েছে। রাজধানী ঢাকায়, বিক্ষোভকারীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, যদি সরকার ইসলাম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে, তবে তারা নিজেরাই শাস্তি কার্যকর করবে। এর কিছুদিন পর, একটি নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করে।
গত ১৫ বছর ধরে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামপন্থীদের দমন ও তোষণের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। তার সরকার চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর ওপর কঠোর অবস্থান নিলেও, একই সঙ্গে হাজার হাজার ইসলামি মাদ্রাসায় অর্থায়ন ও মসজিদ নির্মাণে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ধর্মীয় রক্ষণশীলদের মন জয় করার চেষ্টা করেছিল।
ঢাকার বিক্ষোভে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, "আমরা (নারীরা) জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলাম। আমরা রাস্তায় আমাদের ভাইদের রক্ষা করেছি।" তবে তিনি স্বীকার করেন, "পাঁচ-ছয় মাস পর পুরো পরিস্থিতি উল্টে গেল।"
সমালোচকরা মনে করছেন, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা অভিযোগ করেছেন যে ইউনূস নরম, সংঘাত-বিমুখ এবং চরমপন্থীরা যখন আরও বেশি জনসাধারণের স্থান দখল করছিল, তখন তিনি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনে অক্ষম ছিলেন।
দেশ যে চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে, এমন ‘শঙ্কা’ নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে নিজেই প্রকাশ করেছেন তরুণদের উদ্যোগে গঠিন জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম। কিছু দিন আগে পর্যন্ত তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এদিকে, ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অনেক সদস্য জামিনে মুক্তি পাচ্ছে, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের প্রতিহত করতে হিমশিম খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো এ চ্যালেঞ্জ স্বীকার করলেও, বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যমটির খবরে বলা হচ্ছে, উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খুঁজতে চাওয়া মূলধারার ইসলামপন্থী দলগুলো বাংলাদেশকে আরও ধর্মীয়ভাবে কঠোর রাষ্ট্রে পরিণত করার সুযোগ দেখছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছে। তারা আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম হলেও, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায়।
"ইসলাম পুরুষ ও নারীদের জন্য নৈতিক নির্দেশনা দেয়," বলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। "এই নির্দেশনার মধ্যে নারীরা যে কোনো পেশায় অংশ নিতে পারে—খেলাধুলা, সংগীত, নাটক, বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন।"
তবে, কিছু স্থানীয় নেতা ইসলামী শাসনের নিজস্ব ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিচ্ছেন। রংপুরের তারাগঞ্জ নামে এক গ্রামে স্থানীয় আয়োজকরা নারী ফুটবল ম্যাচের পরিকল্পনা করেছিল যাতে স্থানীয় মেয়েরা খেলাধুলায় উৎসাহিত হয়। কিন্তু স্থানীয় মসজিদের ইমাম আশরাফ আলী এর বিরোধিতা করেন এবং ঘোষণা করেন যে, নারীরা ফুটবল খেলতে পারবে না।
আশরাফ আলী উচ্চস্বরে প্রচার চালিয়ে জনগণকে ম্যাচে অংশ না নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। কর্তৃপক্ষ ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মুখে ম্যাচটি বাতিল করে। "আমি শহিদ হতে রাজি, কিন্তু এই ম্যাচ হতে দেব না," তিনি এক বৈঠকে বলেন।
চার ঘণ্টা বাসে চেপে ভ্রমণের পরেও সেদিনের সেই ফুটবল ম্যাচে অংশ নিতে পারেননি ২২ বছর বয়সী ফুটবলার আক্তার। স্থানীয়দের সিদ্ধান্তে হতবাক হন তিনি। তার ভাষায়: "আমি দশ বছর ধরে ফুটবল খেলছি, কিন্তু এমন ঘটনার সম্মুখীন হইনি। এখন আমি আশঙ্কা করছি সামনে কী হতে পারে।"
নিরাপত্তা বাহিনী উপস্থিত থাকলেও, আয়োজকরা আপসের জন্য খেলোয়াড়দের শর্টসের নিচে স্টকিংস পরতে বলেছিলেন। কিন্তু আশরাফ আলীর চাপের কারণে, তারা নিশ্চিত নয় যে ভবিষ্যতে আবার খেলা আয়োজন করা সম্ভব হবে কি না।
পরে আশরাফ আলী বলেন, "নারীদের ফুটবল অশালীনতা বাড়ায়," তিনি দাবি করেন, এবং এই ঘটনাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার বিজয় বলে অভিহিত করেন।
তার প্রভাব কেবল খেলাধুলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দীর্ঘদিন ধরে, তিনি সংখ্যালঘু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের রাতে, সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থানে আক্রমণ চালানো হয়, বিশেষ করে হিন্দু মন্দিরগুলোর ওপর।
তারাগঞ্জে আহমদিয়াদের উপাসনালয় এখনো নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে—এর সাইনবোর্ড ধ্বংস করা হয়েছে, এবং আজান মাইকে প্রচার করতে দেওয়া হয় না। "সাধারণ জনগণ আমাদের সম্মান করে," বলেন স্থানীয় আহমদিয়া নেতা এ.কে.এম. শফিকুল ইসলাম। "কিন্তু এই ধর্মীয় নেতারা আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।"
এবার নিউ ইউর্ক টাইমসের প্রতিবেদনকে ’মিসলিডিং’ বললো অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার
এদিকে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের এমন প্রতিবেদনের পর নড়েচড়ে বসেছে অর্ত্তবর্তীকালীন সরকার। প্রতিবেদনটিকে ’মিসলিডিং’ব ব্যাখ্যা করে তা প্রত্যাখান করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, প্রতিবেদনটি ধর্মীয় উত্তেজনা ও রক্ষণশীল আন্দোলনের কিছু ঘটনা তুলে ধরেছে, তবে এটি সামগ্রিক উন্নয়নকে উপেক্ষা করেছে।
"বাংলাদেশ নারীদের উন্নতিতে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণে বিশেষভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ," বলেন শফিকুল।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সরকার নারীর অধিকার ও সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আঁকা নেতিবাচক চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।
তিনি উদাহরণ হিসেবে যুব উৎসব - ২০২৫ এর কথা তুলে ধরেন, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লক্ষ মেয়ে ৩,০০০ খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল, যা নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে।
বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, তখন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের সুযোগ নিচ্ছে। দেশটি কি ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে, নাকি উগ্রপন্থার পথে অগ্রসর হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।