এপ্রিল ১, ২০২৫, ০৪:৫০ পিএম
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরে দেওয়া এক বক্তব্যকে ঘিরে ভারতীয় রাজনীতিতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। চীনের বোয়াও ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য, যা ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত, সেগুলোর স্থলবেষ্টিত অবস্থান উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশই সমুদ্রের একমাত্র প্রবেশদ্বার। তাঁর এই মন্তব্য ভারতের বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
চীনের কাছে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “ ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য সম্পূর্ণরূপে স্থলবেষ্টিত। সমুদ্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। আমরাই এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক।
ড. ইউনূসের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘ভারতের সাতটি রাজ্য স্থলবেষ্টিত হওয়ার তাৎপর্য আসলে কী?’
ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার এমন মন্তব্য অবাক করার মতো এবং হতাশাজনক। তিনি জানেন যে উত্তর-পূর্ব ভারত ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই অঞ্চলের সঙ্গে সমুদ্র যোগাযোগ বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি বিদ্যমান।"
ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক প্রফুল্ল বকশি মন্তব্য করেন, "বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ করিডর শিলিগুড়ি করিডরকে কাজে লাগিয়ে ভারতের ওপর চাপ তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। এটি ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য উদ্বেগজনক।”
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য তীব্রভাবে নিন্দনীয় এবং ভারতের কৌশলগত স্বার্থের পরিপন্থী। এটি ভারতের ‘চিকেনস নেক’ করিডোরের দুর্বলতা নিয়ে পাকিস্তান ও চীনের দীর্ঘদিনের প্রচারণাকে মদদ দেবে। ভারতের উচিত দ্রুত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে বিকল্প রেল ও সড়কপথ তৈরি করা, যাতে বাংলাদেশ নির্ভরতা কমানো যায়।”
চিকেন’স নেক করিডোর হল পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির একটি অংশ যা এই অঞ্চলকে ভারতের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করে। নেপাল, বাংলাদেশ এবং ভুটান এই অংশটিকে ঘিরে রেখেছে।
ড. ইউনূসের বক্তব্য নিয়ে কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছে। কংগ্রেসের গণমাধ্যম ও প্রচার বিভাগের প্রধান পবন খেরা বলেছেন, “বাংলাদেশ চীনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারতকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। এটা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য খুবই বিপজ্জনক।”
বাংলাদেশ সরকারের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, ড. ইউনূসের বক্তব্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরা, ভারতবিরোধী কোনো পরিকল্পনা নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে এবং বাংলাদেশ তার অন্যতম অংশীদার। চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরে চীনের বিনিয়োগ ইতিমধ্যেই ভারতের উদ্বেগের কারণ হয়েছে। এ অবস্থায় ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক মন্তব্য আরও নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ড. ইউনূসের মন্তব্য নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন দেখার বিষয়, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কী প্রতিক্রিয়া জানায় এবং বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুতে কী অবস্থান নেয়।