মানবপাচার নিয় বেশ কয়েকটি মিথও তুলে ধরেন বক্তারা। ছবি : দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ।
বিশ্বজুড়ে মানব পাচার এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, বরং এটি রূপ নিয়েছে ভয়াবহ এক সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক অপরাধে। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এই অপরাধচক্র থেকে বছরে মুনাফা হচ্ছে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। শুধু নারী বা শিশুই নয়, পুরুষেরাও এই শোষণের শিকার। পাচারকারীরা এখন এই মানুষগুলোকে ব্যবহার করছে শ্রম শোষণ, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিয়ে, অনলাইন প্রতারণা, এমনকি মাদক পাচারের মতো নানা অপরাধে।
২০২৫ সালের ৩০ জুলাই রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ‘আন্তর্জাতিক মানব পাচার বিরোধী দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরেন বক্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ অভিবাসন নেটওয়ার্কের (BDUNNM) কাউন্টার-ট্র্যাফিকিং ইন পারসনস টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ এই সেমিনারের আয়োজন করে।
আধুনিক দাসত্বে ৫ কোটির বেশি মানুষ
জাতিসংঘের এক প্রবন্ধে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ আধুনিক দাসত্বে জীবন যাপন করছে। এর মধ্যে ১২ মিলিয়ন শিশু এবং ৬১ শতাংশ নারী ও কিশোরী। বক্তারা বলেন, মানব পাচার আর শুধু বন্দুক বা জাহাজের গল্প নয়; এটি এখন একটি প্রযুক্তিনির্ভর, আন্তঃদেশীয়, সংগঠিত অপরাধ, যা বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন, অনিয়মিত অভিবাসন ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিচারাধীন মামলা চার হাজারের বেশি
সেমিনারে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মানব পাচার দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪,২৯১টি। এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ৬৬২টি মামলার নিষ্পত্তি হলেও মাত্র ৩৮টি মামলায় দণ্ড প্রদান করা হয়েছে। পাঁচজন পাচারকারীকে আজীবন কারাদণ্ড, ৫৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা এবং প্রায় ১২০০ জন খালাস পেয়েছেন।
এছাড়া ১,০৭৯টি মামলায় নতুন করে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনি কাঠামো থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ ও সাক্ষ্য সংগ্রহে দুর্বলতা থাকায় বিচারে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না।
ভিকটিম সুরক্ষা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ মানব পাচার প্রতিরোধে বেশ কিছু অগ্রগতি করলেও এখনও বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ভিকটিমদের সাক্ষ্য দিতে ভয় পাওয়া, প্রবাসে আটকে থাকা, কিংবা সাক্ষ্যগ্রহণের প্রযুক্তিগত ঘাটতির কারণে অনেক সময় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের চিফ অব মিশন ল্যান্স বনেও বলেন, “মানব পাচার মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। এটি বন্ধে শুধু আইন নয়, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক অনুসন্ধান এবং আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা লাগবে।”
কোইকার ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর সুজিন কং জানান, তারা ২০ লাখ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়েছেন এবং অনেক ভিকটিমকে পুনর্বাসন, জীবন দক্ষতা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দিয়েছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সেমিনারে আলোচিত হয় ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনাও—জাতীয় রেফারেল মেকানিজম (NRM) সম্প্রসারণ, ভিকটিম শনাক্তকরণ নির্দেশিকা হালনাগাদ, সাক্ষী সুরক্ষা আইন এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বিস্তারের মতো বিষয়।
বিশেষ করে, অনিয়মিত অভিবাসনের মূল কারণ চিহ্নিত করে বৈধ, নিরাপদ ও কম খরচের অভিবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খোন্দকার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা পাচার নির্মূলে কেবল আইনের ওপর নির্ভর করব না, বরং ভিকটিমদের অধিকার ও পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দেব।”
টাস্কফোর্স এবং নজরদারির প্রয়োজনীয়তা
অনুষ্ঠান শেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বিশেষ করে বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন, বন্দর এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নজরদারির ওপর জোর দেওয়া হয়।