২৭ জুলাই

আরও ২ সমন্বয়ক ডিবির হেফাজতে, ৩ দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ২৭, ২০২৫, ১২:৪৬ পিএম

আরও ২ সমন্বয়ক ডিবির হেফাজতে, ৩ দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের ২৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয়। এ নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পাঁচজনকে ডিবির হেফাজতে নেওয়া হয়। 

শনিবার ডিবি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার জানান, ‘গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে জানতে ও তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়েছে।’

এর আগে ২৬ জুলাই শুক্রবার বিকেলে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত অবস্থায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়। 

এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে আদালতের রায়ের পর সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনকে প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। 

শনিবার রাতে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন তিন দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এসব দাবি মানা না হলে পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার কথা জানান তারা। 

শিক্ষার্থীদের তিন দফা ছিল, ‘রোববারের মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ আটক সকল শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন সমন্বয়ক জানান, পুলিশের ধরপাকড়সহ নানা কারণে সব সমন্বয়কের সাথে তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না। যে কারণে সমন্বিতভাবে তারা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারছেন না।

আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, ‘আন্দোলনের মূল দাবি মেনে নেয়া হয়েছে বলে প্রচার করছে সরকার। কিন্তু আমাদের দাবি ছিল কমিশন গঠন করে এই সংকটের সমাধান করা। কিন্তু সেটি করা হয়নি বলেই আমরা এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাখ্যান করছি।’

সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে।

তিনি জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই তিন দফা না মানা হলে পরশুদিন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আরও কঠিন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগামীকাল রোববার থেকে সারা দেশে অনলাইন ও অফলাইন ব্যবহার করে প্রচারণা কার্যক্রম চালাবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দূতাবাসে দলিল পেশ করার পাশাপাশি সারা দেশে দেয়াল লিখন কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।

সংবাদ সম্মেলন থেকে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় ২৬৬ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। এ ছাড়া ছাত্রদের নামে করা মামলাগুলোকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া সোমবার থেকে সারাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলা, উপজেলা ও নগরকেন্দ্রিক ‘হেলথ ফোর্স’ গঠন করে আহত-নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি, এবং আহত-নিহত ছাত্র-নাগরিক ও তাদের পরিবারকে মানসিক ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা এবং ‘লিগ্যাল ফোর্স গঠন করে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের নামে মামলার ডকুমেন্টেশন এবং যাদের আইনি সাহায্যের প্রয়োজন তাদেরকে সেই সাহায্যের ব্যবস্থা করারও ঘোষণা দেয়া হয়।

এদিকে ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়কের খোঁজ নিতে শনিবার বিকেলে ডিবি কার্যালয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল। তারা সেখানে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করলেও ডিবি প্রধান শিক্ষকদের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংকট উত্তরণের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট দিয়ে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বল্প সময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের পক্ষে মত দেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রে সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে একটি প্রকৃত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। জনগণের নির্দেশনায় গণতন্ত্রের সমস্যার প্রতিকার সম্ভব। কারণ, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, সরকারে থাকা কিছু মানুষের জন্য নয়।’ এছাড়া বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধে তিনি বিদেশিদের প্রতি সহায়তার আহ্বান জানান। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত শুক্রবার গভীর রাতে হাতিরঝিলের বাসা থেকে আটক করা হয় ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে।

শনিবার রাত পর্যন্ত কোটা আন্দোলনের সময় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারাদেশে ৭৩৬টির বেশি মামলা হয়। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই মামলা হয় ২০৭টি। ঢাকাতে গ্রেফতার হয় ২ হাজার ৫৩৬ জন। এর বাইরে র‌্যাবের অভিযানে ঢাকায় গ্রেফতার হয় ৭১ জন। সব মিলিয়ে সারাদেশে গ্রেফতার ৭ হাজার ছাড়ায়। ঢাকাসহ সারাদেশের যে সব মামলা হয় তার বেশিরভাগ মামলার বাদী পুলিশ (সূত্র: বণিক বার্তা, ২৮ জুলাই)।

শনিবার সহিংসতায় আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় তিনি আহত চিকিৎসাধীন কয়েকজনের সাথে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন। পরে শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শন করেন। তিনি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজার ক্ষয়ক্ষতিও ঘুরে দেখেন।

এই দিন ওবায়দুল কাদের মেট্রোরেল চালুর বিষয়ে জানান, ‘মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন ধ্বংস করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি এনে এটা এক বছরেও সচল করা সম্ভব হবে না বলে এক্সপার্টরা জানিয়েছেন।’

সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস ২৮ জুলাই রোববার থেকে ৩০ জুলাই মঙ্গলবার পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। 

অন্যদিকে সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নেওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ। তারা সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের যেন হয়রানি করা না হয়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানায়। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে কয়েক দিনের সংঘাতে প্রাণহানি ও সম্পদ ধ্বংসের ঘটনায় ঢাকায় অবস্থিত ১৪টি মিশন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের কাছে লেখা এক যৌথ চিঠিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও মর্মাহতের কথা জানায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যৌথ চিঠিটি পাঠায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দূতাবাস।

দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত সহিংসতা ও বর্তমান ঘটনা প্রবাহে গভীর উদ্বেগ জানায় বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে লেখা এক চিঠিতে এ উদ্বেগ জানান তারা। সেই সঙ্গে তারা এ বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। ১৪০ জনের বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তি এ চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও নানা বাস্তবতায় তাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই বলে জানায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা। 

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে জনজীবন। এমন পরিস্থিতিতে ২৬ জুলাই শুক্রবার থেকে কারফিউ শিথিলের সময়সীমা বাড়িয়ে দেয় সরকার। শনিবার বিকেল ৫টার পর পুনরায় কারফিউ শুরু হওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, মোড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে অবস্থান নেয় সেনা সদস্যরা। এই দিন অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সেনা সদস্যদের রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোয় টহল দিতে দেখা যায়।

শনিবার রাতে নিজ বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলায় রবি, সোম ও মঙ্গলবার কারফিউ অব্যাহত থাকবে। এসব এলাকায় সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১১ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকবে।

জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা ও নাশকতার জন্য দায়ীদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা করে বিচার করার দাবি জানান।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘বিরোধীদের দমনে সরকার মধ্যযুগীয় নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে কল্পকাহিনী রচনা করা হচ্ছে।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানায় হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যেন কোনোভাবে হয়রানি করা না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতার আহ্বান জানানো হয়।

এছাড়া এই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহতের দায় নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানায় বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা।

তিন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে নেওয়ার ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন ন্যক্কারজনক ঘটনা’ বলে আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দাবি জানায় বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা, বাংলাদেশ জাসদ। এছাড়াও সিপিবির নারী সেল ও সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম এবং বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠন মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট একই দাবি জানায়।

সূত্র: বাসস।  

Link copied!