থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে টানা দ্বিতীয় দিন সংঘাত, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ২৫, ২০২৫, ১১:৪৯ এএম

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে টানা দ্বিতীয় দিন সংঘাত, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার

ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সেনাদের মধ্যে সীমান্তে টানা দ্বিতীয় দিন সংঘাতে দুই পক্ষই ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

শুক্রবার ভোরের আগে উবোন রাচাথানি ও সুরিন প্রদেশের সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষ হয়েছে বলে জানিয়েছে থাই সামরিক বাহিনী।

“কম্বোডীয় বাহিনী ভারী অস্ত্র, কামান ও বিএম-২১ রকেট দিয়ে টানা বোমাবর্ষণ চালিয়েছে, কৌশলগত পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে থাই বাহিনীও পাল্টা গুলিতে উপযুক্ত জবাব দিয়েছে,” বিবৃতিতে তারা এমনটা বলেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

থাই কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা সীমান্ত এলাকা থেকে এক লাখ লোককে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে।

বৃহস্পতিবারের এই সীমান্ত সংঘাত শুরুর জন্য উভয় দেশই একে অপরকে দায়ী করছে। প্রথমে ছোট অস্ত্রে গোলাগুলি হলেও হলেও দুই পক্ষই পরে হামলায় ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার শুরু করে।

রয়টার্সের সাংবাদিকরা শুক্রবার সুরিন প্রদেশে থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় সড়কে ও গ্যাস স্টেশনগুলোতে বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র থাই সেনার উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে।

বুধবার রাতে থাইল্যান্ড নম পেন থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরে আসতে বলে এবং কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে। এর কয়েক ঘণ্টা পরই দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়।

ব্যাংককের দাবি, কম্বোডিয়া সীমান্তে নতুন করে স্থলমাইন পুঁতেছে; তারই ধারাবাহিকতায় বিরোধপূর্ণ অংশে টহল দিতে গিয়ে স্থলমাইন বিস্ফোরণে দুই থাই সেনা অঙ্গ হারায়। কম্বোডিয়া সীমান্তে নতুন মাইন পোঁতার অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন অ্যাখ্যা দিয়ে আসছে।

দুই পক্ষের সংঘাতে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত থাইল্যান্ডে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ১৪ জনই বেসামরিক বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আহত হয়েছে ৪৬ জন, তাদের মধ্যে সেনার সংখ্যা ১৫।

কম্বোডিয়ার সরকার তাদের পক্ষে হতাহতের কোনো তথ্য দেয়নি। সাম্প্রতিক সংঘাত নিয়ে মন্তব্য চাইলেও সরকারের এক মুখপাত্র তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেননি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

তবে দেশটির ওদ্দার মিনচেই প্রাদেশিক প্রশাসনের মুখপাত্র মেথ মিয়াজ ফিকদেই সংঘাতে একজন নিহত ও প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে খবর দিয়েছেন।

সংঘাতের মধ্যে থাইল্যান্ড বৃহস্পতিবার সীমান্তে ছয়টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান জড়ো করে, যাকে বিরল পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সামরিক বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে একটি এফ-১৬ কম্বোডিয়ার একটি সামরিক স্থাপনায় হামলাও চালিয়েছে। কম্বোডিয়া থাইল্যান্ডের হামলাকে ‘বেপরোয়া ও নির্মম সামরিক আগ্রাসন’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার সংঘাতের খবর পাওয়ার পর থাইল্যান্ড জানায়, কম্বোডিয়ার সেনারা একাধিক থাই গ্রাম ও একটি হাসপাতালে রকেট নিক্ষেপ করেছে। এর জবাবে থাইল্যান্ডও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান নিয়ে কম্বোডিয়ার সামরিক লক্ষ্যস্থলগুলোতে আঘাত হেনেছে।

থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার সঙ্গে তাদের পুরো সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে সীমান্তের কাছে বসবাসকারী নাগরিকদের সেখান থেকে সরে আসারও নির্দেশ দেয়।

অপরদিকে কম্বোডিয়া থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘অতিরক্তি বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ তুলে। তাদের পক্ষে কতজন হতাহত হয়েছে তা এখনও বলেনি তারা।

থাইল্যান্ডের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) মুখপাত্র দাবি করেন, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৭টার পর সীমান্তের কাছে থাই সেনা অবস্থানে নজরদারি করতে কম্বোডিয়া একটি ড্রোন মোতায়েন করে।

কিছুক্ষণ পর কম্বোডিয়ার সেনারা সীমান্তের কাছে আরপিজি এনে জড়ো করে। থাই সেনারা চিৎকার করে তাদের ডেকে আলোচনা করতে চাইলেও সফল হয়নি। এরপর কম্বোডিয়ার সেনারা ৮টা ২০ মিনিটের দিকে আরপিজি থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলে থাই পক্ষ জবাব দিতে বাধ্য হয়।

অন্যদিকে কম্বোডিয়া বলছে, স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৬টার দিকে থাইল্যান্ডের সেনারা আগের চুক্তি লঙ্ঘন করে বিরোধপূর্ণ সীমান্তের খামের-হিন্দু মন্দির তা মোয়ান থোমের দিকে অগ্রসর হয়।

কিছুক্ষণ পর তারা সীমান্তে ড্রোন মোতায়েন করে এবং সাড়ে ৮টার দিকে প্রথমে উপরের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে এবং পরে কম্বোডিয়ার সেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে, অভিযোগ কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

মন্ত্রণালয়টির মুখপাত্র মালি সওচেতা বলেন, থাই সেনারা বিনা উস্কানিতে আক্রমণ করার পর কম্বোডিয়ার সেনারা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুড়েছে।

থাইল্যান্ড সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে, তাদের সেনাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে এবং কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে ফরাসিরা কম্বোডিয়ার দখলদারিত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশী দেশ নিজেদের সীমান্ত নির্ধারণ করে। তখন থেকেই ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের কিছু অংশ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে দ্বিমত রয়ে যায় এবং পরে সেসব অংশকে কেন্দ্র করে বিরোধ দেখা দেয়। এই সীমান্ত সহিংসতা সেই বিরোধ নিয়ে উত্তেজনার সর্বশেষ নজির।

দুই পক্ষের সীমান্ত বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে প্রাচীন দুই হিন্দু মন্দির, তা মোয়ান থোম ও একাদশ শতকের প্রেহ ভিহেয়ার।

১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) প্রেহ ভিহেয়ারকে কম্বোডিয়ার বলে রায় দিলেও থাইল্যান্ড তা মানতে নারাজ।

পরে ২০০৮ সালে কম্বোডিয়া এই মন্দিরটিকে ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। এরপর কয়েক বছর একাধিক সংঘর্ষ হয় এবং ডজনের বেশি মানুষ মারা যায়।

কম্বোডিয়া চলতি বছরের জুনে জানায়, তারা থাইল্যান্ডের সঙ্গে তাদের বিরোধ মেটাতে আইসিজেকে অনুরোধ করেছে।

অন্যদিকে থাইল্যান্ড বলেছে, তারা কখনোই আইসিজের খবরদারি মানবে না এবং বিরোধ কেবল দ্বিপাক্ষিকভাবেই মেটানো যাবে।

সীমান্ত সংঘাতে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার তুলনায় তাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের পরিমাণ ও পাল্লা যে বেশি তাও দেখিয়ে দিয়েছে।

প্রতিবেশী এই দুই দেশের সংঘাতে আশপাশের অন্যান্য দেশও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফিলিপিন্স ও ভিয়েতনাম বিবদমান দুই পক্ষকে সংযত হতে আহ্বান জানিয়েছে। চীন বলেছে, তারা থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করতে প্রস্তুত।

Link copied!