২০২৪ সালের ২৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক — নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং আবু বাকের মজুমদার —কে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি রাত সাড়ে ১১টার দিকে স্বীকার করে জানায়, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে এবং সহিংসতা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য তাদের জানা আছে কিনা, তা জানতে চাওয়া হবে।
এর আগে বিকেলে নাহিদের পরিবার অভিযোগ করে, বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারীরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে হাসপাতাল থেকে প্রথমে নাহিদ, পরে আসিফ ও বাকেরকে তুলে নিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, এর আগে ১৯ জুলাই রাতেই খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া থেকে নাহিদকে অপহরণ করা হয়। পরে ২১ জুলাই ভোরে পূর্বাচলে তাকে আহত অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়। একই রাতে আসিফ ও বাকেরকেও তুলে নেওয়া হয় এবং ৫ দিন পর যথাক্রমে ২৪ জুলাই হাতিরঝিল ও ধানমন্ডিতে ফেলে যাওয়া হয়। তারা সবাই তখন থেকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ঘটনার পরদিন রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন এবং কারা যেন তাদের হুমকি দিচ্ছিল। সে কারণে তাদের ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
এদিন কোটা আন্দোলন ঘিরে রাজধানী ও সারা দেশে সহিংসতা, বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্লক রেইড চালিয়ে শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান।
প্রথম আলো পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, ১৭ থেকে ২৬ জুলাই ১০ দিনে সারা দেশে গ্রেফতার হন মোট ৬ হাজার ২৬৪ জন। শুধু ২৫ জুলাই রাত থেকে ২৬ জুলাই দুপুর পর্যন্ত গ্রেফতার হন ৭৬৫ জন। ঢাকায় ওইদিন গ্রেফতার হন ২০৭ জন, ফলে রাজধানীতে ১০ দিনে মোট গ্রেফতার ২ হাজার ৪১৬ জনে পৌঁছায়। ওইদিন ঢাকার বাইরে ২২টি ও ঢাকায় আরও ৮টি মামলা হয়, ঢাকায় মোট মামলা দাঁড়ায় ২০৯টি।
এইদিনই রংপুরের পীরগঞ্জে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের পরিবারকে সাড়ে সাত লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকটির নামকরণ করা হয় ‘শহীদ রুদ্র তোরণ’।
এদিকে, সহিংসতায় আহত আরও তিনজন ২৬ জুলাই ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারা দেশে গণগ্রেফতার, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের প্রতিবাদে সরকারের পদত্যাগ দাবিতে ‘জাতীয় ঐক্য’র আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন ঢামেকে সহিংসতায় আহতদের দেখতে গিয়ে বলেন, দলমত নির্বিশেষে যারা আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসা ও জীবিকা নিশ্চিত করবে সরকার। এর আগে সকালে তিনি রামপুরায় নাশকতায় ক্ষতিগ্রস্ত বিটিভি ভবন পরিদর্শন করেন।
আন্তর্জাতিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির এমপি ড. রুপা হক বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ও যুক্তরাজ্য সরকারের অবস্থান জানতে চান। কানাডা সরকার সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
এইদিন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে জানায়, মতপ্রকাশের অধিকার সাংবিধানিক, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অপরাধ নয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) প্রত্যেক প্রাণহানির নিরপেক্ষ তদন্ত ও ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানায়।
বামপন্থী দল ও জোটসমূহ রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়ে সরকারকে আন্দোলনকালীন সহিংসতা ও প্রাণহানির দায় নিতে বলে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি সহিংসতার ঘটনায় সম্পদ ধ্বংস ও প্রাণহানির সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিচার দাবি করে।
২৬ জুলাই- ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে, যখন আন্দোলন, নিপীড়ন, রাজনীতি ও জনচেতনার বহুমাত্রিক ধারা একই দিনে সংঘর্ষে মিলিত হয়।