যুদ্ধের ভাষ্যকার, পাখির শিল্পী: চলে গেলেন হামিদুজ্জামান খান

বিশেষ প্রতিবেদক

জুলাই ২০, ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম

যুদ্ধের ভাষ্যকার, পাখির শিল্পী: চলে গেলেন হামিদুজ্জামান খান

ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ঢাকার রাজপথে তখন নেমে এসেছে নৃশংস এক বিভীষিকা। ২৭ মার্চ, নিউ মার্কেট এলাকায় তরুণ শিল্পী হামিদুজ্জামান খান দেখলেন অসংখ্য মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে আটক করেছিল, পরে তিনি ছাড়া পান। কিন্তু ওই দিনকার অভিজ্ঞতা, যুদ্ধের নৃশংসতা ও মানুষের সীমাহীন দুর্দশা চিরতরে বদলে দিল তার শিল্পীসত্তাকে। স্বাধীনতা অর্জনের পরে প্রথম দুই দশকজুড়ে তার অধিকাংশ ভাস্কর্যের বিষয় হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধ। এই শিল্পী ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করলেন ব্রোঞ্জ, ইস্পাত ও পাথরের নিঃশব্দ ভাষায়। 

রোববার, ২০ জুলাই ২০২৫, সকাল ১০টা ৭ মিনিটে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের অন্যতম কৃতী ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী হামিদুজ্জামান খান।

মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। 

১৯৪৬ সালের ১৬ মার্চ কিশোরগঞ্জের সহশ্রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করা হামিদুজ্জামান ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ (তৎকালীন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস কলেজ) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। জলরঙে চিত্রাঙ্কন দিয়ে তার শিল্পজীবন শুরু হলেও খুব দ্রুত তিনি আকৃষ্ট হন ভাস্কর্যে। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং আজীবন থেকে যান এই মাধ্যমে। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি নির্মাণ করেন একের পর এক ঐতিহাসিক ভাস্কর্য: গাজীপুরে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ‘জাগ্রত বাংলা’, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংশপ্তক’, ঢাকা সেনানিবাসে ‘বিজয় কেতন’, মতিঝিলে ‘ইউনিটি’, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ‘ফ্রিডম’, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বাধীনতা চিরন্তন’, আগারগাঁওয়ে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’, মাদারীপুরে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’।

এগুলো শুধু ভাস্কর্য নয়, ইতিহাসের স্ফটিক নিদর্শনএক জাতির সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের কাব্যরূপ। 

সেই একই শিল্পী, যিনি পাথর ও ইস্পাতে বন্দি করেছিলেন এক জাতির রক্তাক্ত ইতিহাস, তিনি আশির দশকে ফিরে তাকান পাখির দিকেএকটি নীরব, কোমল আশ্রয়ের প্রতীকে। সেই থেকেই তার শিল্পে আসে রূপান্তর, বিমূর্ততায় ধরা দেয় উড়াল, শান্তির প্রত্যাশা। পাখি হয়ে ওঠে তার দ্বিতীয় ভাষ্য—স্বপ্ন আর স্বাধীনতার, স্বজনহারা শূন্যতার মধ্যেও জীবনের।

বঙ্গভবনে ‘পাখি পরিবার’, গুলশানে ইউনাইটেড ভবনের ‘পাখি’র উড়ান, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ‘শান্তির পাখি’ ভাস্কর্যের মাধ্যমে তিনি প্রকৃতি ও স্বপ্নের সংলাপ রচনা করেন। 

আন্তর্জাতিকভাবেও হামিদুজ্জামান খান তার সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেনদক্ষিণ কোরিয়ার পুয়ো ভাস্কর্য পার্ক, সিউল অলিম্পিক উদ্যানে ‘স্টেপস’, নিউইয়র্ক স্কাল্পচার সেন্টারে প্রশিক্ষণ গ্রহণসব মিলিয়ে তার কাজ পেয়েছে বৈশ্বিক সম্মান। 

চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক হিসেবে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিল্পচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার একক প্রদর্শনীর সংখ্যা ৪৭টির বেশি, আর নির্মিত ভাস্কর্য প্রায় ২০০। 

বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০২৩ সালে চারুশিল্পে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। 

হামিদুজ্জামান খান ছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে কল্পনার পাখিকে উড়িয়েছেন নীলাকাশে। তার শিল্পে যেমন রয়েছে ইতিহাসের গভীর বেদনা, তেমনি রয়েছে শান্তি ও স্বপ্নের আরাধনা। বাংলাদেশের শিল্প-ইতিহাসে তার অবদান চিরকাল অম্লান থাকবে। 

দুই সত্তাযুদ্ধের ভাষ্যকার ও পাখির শিল্পীছিলেন হামিদুজ্জামান খান। আজ তিনি নেই। কিন্তু তার গড়া ভাস্কর্যগুলো বাংলাদেশের মাঠে-প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আজও বলছে সেইসব গল্পযা পাথর দিয়ে গড়া হলেও প্রাণে পূর্ণ।

বিদায়, শিল্পী। আপনার ভাস্কর্য বেঁচে থাকবে, যেমন করে বেঁচে থাকে কোনো জাতির আত্মার প্রতিচ্ছবি। 

Link copied!