কমছে ক্রেতা, নতুন বাজারের খোঁজে পোশাক উদ্যোক্তারা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ২৪, ২০২২, ১২:০১ এএম

কমছে ক্রেতা, নতুন বাজারের খোঁজে পোশাক উদ্যোক্তারা

বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের অতিমূল্যের ফলে দেশের তৈরি পোশাক খাত অনেকটাই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। পোশাকের জন্য নতুন অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি চলমান অর্ডারও স্থগিত রাখা হচ্ছে। ওয়ালমার্টসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নতুন ক্রয়াদেশ না দেয়ায় তিন ভাগের একভাগ রপ্তানি অর্ডার কমেছে। ফলে পোশাক উদ্যেক্তারা পণ্য উৎপাদনের চেয়ে নতুন ক্রেতা খুঁজছেন। এজন্য বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন তারা। তবে কোনো সু সংবাদ বয়ে আনতে পারেননি।  

বড় ধাক্কা ওয়ালমার্টের সিদ্ধান্তে

এককভাবে দেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট ঘোষণা দিয়েছে ৩০ শতাংশ অর্ডার কমিয়ে দেবে। এতে চরম আতঙ্কে পড়েছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। তারা মনে করেন, আবারও গভীর সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশের পোশাক শিল্প। গত দুই বছরে পোশাকের দাম তো বাড়ায়ইনি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো, উল্টো এখন অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। এই কারণে পোশাক শিল্প করোনা মহামারির সময়কার মতো আবারও গভীর সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের নিট পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ’র  সহ সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে শুধু ওয়ালমার্ট নয়, বিশ্বের অনেক দেশের নামি-দামি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও এখন অর্ডার বাতিল করছে। আমি যে বায়ারের কাজ করি তারাও গত বছরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ অর্ডার কমিয়েছে। এভাবে এখন গড়ে ৩০-৩৫ শতাংশ অর্ডার কম আসছে গার্মেন্টস শিল্পে। যা দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

নতুন ক্রেতা পাচ্ছে না উদ্যোক্তারা

বৈশ্বিক পরিস্থিতি খারাপ হবার আশঙ্কায় গত জুন মাস থেকেই উদ্যোক্তারা নতুন বাজারের খোঁজ শুরু করে। সে সময় তারা ইরান, উজবেকিস্তান, কাজাখিস্তানসহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তাদের সাথে আলাপ করে। কিন্তু সেই আলাপ ফলপ্রসু হয়নি। এছাড়া আফ্রিকান বেশ কিছু দেশেও উদ্যোক্তারা নতুন বাজারের সন্ধান করে। মরক্কো,চাদসহ বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ রাখলেও তারা পোশাক ক্রয়ের চেয়ে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী।

এছাড়া বেশ কিছু দেশ নিজেরাই পোশাক কারখানা স্থাপন করেছে। যার ফলে সেই সব দেশের বাজার না পাবার সম্ভাবনা পাশাপাশি ঐ অঞ্চলের বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ।

বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল  বলেন, “আমরা আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে সতর্ক ছিলাম বা প্রস্তুত ছিলাম, সেজন্য বিষয়টি আমাদের কাছে নতুন কিছু না। তবে শিল্পের জন্য এটা বড় ধাক্কা। কেননা এমনিতেই জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।”

জ্বালানি সংকটে মান নিয়ে শঙ্কা

পোশাক উৎপাদনের জ্বালানি সংকট বড় ভোগান্তি বলে জানান উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, গত দুই ধাপে প্রায় ৭৫ শতাংশ (গত ৫ জুন ৫০ শতাংশ, তার আগে ২৫ শতাংশ) জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় এমনিতেই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এমনিতেই উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে পোশাক শিল্পে।

তারা বলছেন, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় পোশাক উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। বাড়তি খরচ সামাল দেওয়ার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না পোশাক কারখানার মালিকরা।

তবে শুধু আর্থিক ক্ষতিই নং বরং মান রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ীদের। নারায়ণগঞ্জের নিট কারখানাগুলোতে দিনের বেলা গ্যাসের চাপ ২-৩ পিএসআইয়ের বেশি থাকছে না। সে কারণে কাপড় রং করা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ক্রয়াদেশ কমার পাশাপাশি আমাদের নতুন দুশ্চিন্তা গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট।

মূল্যস্ফীতি সামঞ্জস্য করতে পারছে না উদ্যোক্তারা

পোশাক খাতের মালিকরা বলছেন, বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে- এমন পোশাকের দাম অন্তত দুই মাস আগে নির্ধারণ করা হয়েছে। তখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী চুক্তি হয়েছে। অথচ তার মধ্যেই হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় খরচ বেড়ে গেছে। উৎপাদন পর্যায়ে এসে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের সুযোগ নেই। ফলে লোকসান গুনেই পোশাক উৎপাদন করতে হচ্ছে তাদের।

অন্যদিকে দেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারি তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, জুলাই শেষে জোটে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এটা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর পোশাকের একক প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ। এটা গত ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূলত রেকর্ড মূল্যস্ফীতির কারণে এসব দেশে পোশাকের চাহিদা কমছে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সুসম্পর্ক থাকে সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তার জন্য শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং কাঁচামাল আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ বিষয়ে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে রফতানি। অথচ পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যে বায়ার থেকে নতুন অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি চলমান অর্ডারও স্থগিত রাখা হচ্ছে। আমরা কঠিন সময় পার করছি।

নানাভাবে জুলুমের শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “এনবিআরের পলিসি ব্যবসাবান্ধব নয়। ব্যাংকগুলোও নানাভাবে জুলুম করছে। আন্তর্জাতিকসহ নানাভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। গ্যাস সঙ্কটে উৎপাদন কমছে। এ কারণে রফতানির পরিবর্তে আমদানি বাড়ছে। এতে সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

Link copied!