তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চীনের, প্রভাব পড়তে পারে বাণিজ্যে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ৩, ২০২২, ০৯:১৬ পিএম

তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা চীনের, প্রভাব পড়তে পারে বাণিজ্যে

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে ঘিরে বেইজিং ও তাইপের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিশোধ নিতে চীন বালি রপ্তানি ও দেশটি থেকে ফল-মাছ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা  দিয়েছে। এমতাবস্থায় বিশ্ব বাণিজ্য অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়তে পারে বলে  মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

গত কয়েক বছরে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে বেড়েছে চীনের সামরিক তৎপরতা। এ সময় কয়েক শ’বার চীন তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের এই সামরিক তৎপরতা বৈশ্বিক মনোযোগের কারণ হয়েছে। উত্তেজনাকর এই অবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে।

পেলোসির এই সফরের পরিকল্পনার সময়ই কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল চীন। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার বুধবার দেশটি সফরে আসেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিয়েছে চীন। বুধবার দেশটির সাথে বাণিজ্য সীমাবদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাইপেতে বালি রফতানি এবং দেশটি  থেকে সাইট্রাস জাতীয় ফল ও মাছ আমদানি বন্ধ করেছে বেইজিং।

এর আগে তাইওয়ানের চারপাশে ‘পরিকল্পিত সামরিক অভিযান’ এবং লাইভ ফায়ার ড্রিল ঘোষণা করে চীন।

এর নিন্দা জানিয়েছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন। অন্যদিকে সফরে এসে তাইওয়ানকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন ন্যান্সি পেলোসি। চীনা হুমকির মুখে রাতে তাইওয়ানে নেমে বুধবার সকালে দেশটির পার্লামেন্টে ভাষণ দেন ন্যান্সি পেলোসি। ভাষণে জানিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের মধ্যে সংসদীয় আদান-প্রদান তিনি আরও বাড়াতে চান। একই সঙ্গে ভাষণে তিনি তাইওয়ানকে 'বিশ্বের অন্যতম মুক্ত সমাজ' আখ্যায়িত করেছেন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে  পেলোসির সফরের প্রতিবাদ জানাতে বেইজিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এতকিছুর পর প্রশ্ন আসতেই পারে কেন এই উত্তেজনা?

চীন-তাইওয়ানের উত্তেজনার পেছনে রয়েছে তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি। চীন তাইওয়ানকে মনে করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ হিসেবে। চীনের বিশ্বাস, তাইওয়ান একসময় চীনের সাথে পুনরায় একত্রিত হবে, চীনের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। অন্যদিকে, তাইওয়ানের অধিকাংশ মানুষই এই মতবাদের সাথে একমত পোষণ করেন না। একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবেই থাকতে চায় তাইওয়ানের অধিকাংশ মানুষ।

চীনের রেকর্ডে এই দ্বীপের প্রথম উপস্থিতি পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৯ অব্দে। তাইওয়ান একটি ক্ষুদ্র সময় ডাচ কলোনি (১৬২৪-১৬৬১) হিসেবে ছিল, সেখান থেকে আবার তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ যায় কুইং সাম্রাজ্যের কাছে, তারা শাসন করে ১৬৮৩ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত।এরপর, ১৮৯৫ সালের প্রথম সিনো-জাপানিজ যুদ্ধে চীনের কুইং সরকার পরাজিত হয় জাপানের কাছে। এর ফলে তাইওয়ান চলে যায় জাপানের সম্রাটের অধীনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে জাপান আত্মসমর্পন করলে তাইওয়ানের ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় চীনের কর্তৃত্ব। কিন্তু, পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যমে দ্বীপটিতে খুলে যায় গণতন্ত্রায়নের পথ। চীন আর তাইওয়ানের সম্পর্কের উন্নয়ন শুরু হয় গত শতাব্দীর আশির দশকে। চীন তাইওয়ানকে 'এক দেশ, দুই নীতি' অনুসরণ করে পুনঃএকত্রীকরণের প্রস্তাব দেয়।

তাইওয়ান চীনের এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তবে, তাইওয়ান চীনে ভ্রমণ আর বিনিয়োগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে। ১৯৯১ সালে চীনের সাথে যুদ্ধের সমাপ্তির ঘোষণা দেয় তাইওয়ান।

উত্তেজনার নতুন মাত্রা

নতুন করে আবার উত্তেজনা তৈরি হয় সাই ইং-ওয়েন দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর থেকে। সাই ইং-ওয়েনের রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টিকে কেন্দ্র করে। এই দলটি খোলাখুলিভাবেই তাইওয়ানের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।

আর সাই ইং-ওয়েনের হাত ধরেই তাইওয়ানের সাথে প্রায় চারযুগ পরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে বিভিন্ন সময় তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা খাতে এবং চীনের আগ্রাসনের বিপরীতে নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে সহোযোগিতা করেছে।

এদিকে ২০১৮ সাল জুড়েই চীন আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করেছে, তাইওয়ানকে কোম্পানির ওয়েবসাইটে চীনের অংশ হিসেবে দেখানোর জন্য। এই পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক উন্নতি শুরু হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন স্টেট ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাইওয়ানে যান। আর সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া বৈঠক ছিল কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো শীর্ষপর্যায়ের বৈঠক।

যুক্তরাষ্ট্র আর তাইওয়ানের কর্মকর্তাদের বৈঠক চলার মধ্যেই চীন সামরিক মহড়ার আয়োজন করে তাইওয়ানের ভূখণ্ডের পাশে।

চলতি বছর  বাইডেন প্রশাসন তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাকে পুনঃব্যক্ত করে। তাইওয়ান সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই চীনের যুদ্ধবিমান বেশ কয়েকবার তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। চলতি বছরের ১২ এপ্রিল তাইওয়ান জানায়, চীনের রেকর্ডসংখ্যক যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।

এই বিরোধ কি শুধুই রাজনৈতিক?

চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের বড় ধরণের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তাইওয়ানের রপ্তানির প্রায় ৩০ ভাগই চীনে হয়ে থাকে। তাইপের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হলো বেইজিং। ২০১০ সালে চীন ও তাইওয়ান একটি বাণিজ্যিক সমঝোতায় স্বাক্ষর করে। সমঝোতা অনুযায়ি চীন ও তাইওয়ান তাদের পরস্পরের বাজারে বিক্রি করে, এমন আটশো পণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে ঐক্যমতে পৌঁছায়।

রাজনৈতিক সম্পর্কের তেমন অগ্রগতি না হলেও, এই চুক্তির ফলে তাইওয়ান চীনের ওপর আরো বেশী করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাইওয়ানিজ কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই চীনে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। প্রায় এক মিলিয়ন তাইওয়ানিজ চীনে বসবাস করে এবং এদের মধ্যে অনেকই চীনে কলকারখানা স্থাপন করেছে।

তাইওয়ানিজদের অনেকেই মনে করেন তাদের অর্থনীতি চীনের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। আবার অনেকে মনে করেন, চীনের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নতির ফলে সামরিক আগ্রাসনের সম্ভাবনা কমবে।

বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাব 

বাংলাদেশের বৃহত্তম দুই বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে,  এক্ষেত্রে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশ দুটির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখাটাই হয়ে দাঁড়াতে পারে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

তাইওয়ানকে নিয়ে আগেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। ২০০৪ সালে তৎকালীন সরকারের কয়েকজন নীতিনির্ধারকের তৎপরতায় ঢাকায় বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক দপ্তর খোলার অনুমতি পায় তাইওয়ান। ওই সময় এ বিষয়টিতে বেইজিংকে বেশ ক্ষুব্ধ করে তোলে।

বিশ্লেষকদের মতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। দুই দেশই বাণিজ্য খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই অংশীদার। এর মধ্যে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে রফতানি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া দেশে আমদানীকৃত পণ্যের উৎস হিসেবে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে দেশটি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর(ইপিবি)  পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের  ৯২৪ কোটি ২২ লাখ ৮ হাজার ৬৫৩ ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এর মধ্যে রফতানি হয়েছে ৬৯৭ কোটি ৪০ লাখ ৮ হাজার ৬৫৩ ডলারের পণ্য। অর্থমূল্য বিবেচনায় দেশের মোট পণ্য রফতানির ১৮ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া এ সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। শিল্প-কলকারখানার কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে দেশে ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক যন্ত্র এবং যন্ত্রাংশের বাজার দাঁড়িয়ে আছে অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভর করে। অর্থমূল্য বিবেচনায় দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। গত অর্থবছরে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য হয়েছে ১ হাজার ৩৬০ কোটি ৫৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯০৫ ডলারের। এর মধ্যে রফতানি হয়েছে ৬৮ কোটি ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯০৫ ডলারের। আমদানি হয়েছে ১ হাজার ২৯২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য।

Link copied!