দেশে একযুগে পেঁয়াজের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। উৎপাদন বাড়লেও দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আমদানি। তবে প্রশ্ন থেকে যায় ঠিক কি কারণে বাংলাদেশের পেঁয়াজের চাহিদা এত। আর একযুগে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির নেপথ্যে কারণ কি?
এক যুগে দ্বিগুণ উৎপাদন
২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার মে.টন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ধরা হয় ৩ লাখ ৬০ হাজার মে.টন। অর্থাৎ এক যুগে দ্বিগুন হয়েছে পেঁয়াজের উৎপাদন।
উৎপাদন বাড়লেও আমদানিতে শীর্ষে বাংলাদেশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭ লাখ ২৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করে। ওই বছর আর কোনো দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেনি। বাংলাদেশের পর যে দেশটি সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করেছে, সেটি যুক্তরাষ্ট্র। তাদের আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। এরপরের অবস্থানে ছিল মালয়েশিয়া। তাদের আমদানি সোয়া পাঁচ লাখ টন।
খাদ্যাভাস থেকে অর্থনৈতিক দিক
পেঁয়াজের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য মূলত দুটি বিষয়। প্রথমটি খাদ্যাভাস ও দ্বিতীয়টি অর্থনৈতিক।
দেশের আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য পোলট্রি খাতকে উৎসাহী করা হয়। ২০০৮ সালে ‘জাতীয় পোলট্রি উন্নয়ন নীতিমালা’ হবার পরপরই মাংস উৎপাদনের হার বাড়ে। সুলভ মূল্যে হবার কারনে পোলট্রি মাংস গ্রহণের পরিমান বৃদ্ধি পায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ৫৮ হাজার মে.টন পোলট্রি উৎপাদিত হয়। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় প্রায় ৩৮ লাখ মে.টনে। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে প্রায় ৬ গুণ বৃদ্ধি পায়।
এই পোলট্রির মাংসের রন্ধনপ্রক্রিয়ার জন্যই পেঁয়াজের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে বলে জানায় পুষ্টিবিদ দীনার লাকি। তাঁর মতে, শুরুতে পোলট্রির মাংসে ঝাঁঝালো স্বাদ ও গ্রেভির জন্য পেঁয়াজের ব্যবহার বেশি হয়।
তিনি বলেন, পেঁয়াজের মধ্যে সালফার বিদ্যমান থাকায় এটি রান্নায় একধরনের ঝাঁঝালো স্বাদ যোগ করে। এ কারণে পেঁয়াজ দিয়ে রান্না খাবারের স্বাদ অনেক তীব্র হয়। পেঁয়াজ যেকোনো তরকারিকে গ্রেভি ও আকর্ষণীয় করে।
তাই রেস্তোরা থেকে শুরু করে অন্যান্য রন্ধনপ্রণালীতে পেঁয়াজের ব্যবহার বেড়ে যায়। যত বেশি পোলট্রির মাংস রান্না হচ্ছে ততই পেঁয়াজের ব্যবহার বাড়ে।
তবে শুরুতে দেশীয় পেঁয়াজের ব্যবহার বাড়লেও ধীরে ধীরে আমদানি নির্ভর হয়ে যেতে থাকে পণ্যটি।
তিনি আরও বলেন, আকারে বেশি বড় না হলেও এ দেশের পেঁয়াজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ঝাঁঝালো বেশি হয়। কারণ, এতে এলিসিনের মাত্রা বেশি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আর এই ঝাঁঝালো স্বাদের জন্যই আমাদের দেশের পেঁয়াজ দিয়ে রান্না অনেক মজা হয়। তবে ধীরে ধীরে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ায় আমদানিতেও জোর প্রদান করা হয়।
তবে পেঁয়াজের ব্যাপক ব্যবহার শুধু রন্ধন শিল্প নয় বরং অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে বলে জানান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে পেঁয়াজের ভোগও বেড়ে যায়। এখন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা বাড়ার কারণে পেঁয়াজের ব্যবহার আরও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, পেঁয়াজ নির্ভর বিভিন্ন প্রসাধনীর বাজারও কিন্তু ভাল। তাই এক সময়ে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে এ চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। এ কারণে পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ নয় ভারতীয় উপমহাদেশে পেঁয়াজের ব্যবহার বেশ প্রাচীন। যদিও তখন সরাসরি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার কম হতো বরং ঔষধি পণ্য হিসেবে এর ব্যবহার ছিল। ভারতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যার গ্রন্থ চক্র সংহিতাতেও ওষুধ হিসাবে পেঁয়াজের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হৃদপিন্ড ও চোখের জন্য উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।