শ্রীলঙ্কার চেয়েও নাজুক অবস্থায় দেশের ব্যাংক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২০, ২০২২, ০৪:৫০ পিএম

শ্রীলঙ্কার চেয়েও নাজুক অবস্থায় দেশের ব্যাংক

প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে মূলধন সংরক্ষণে পিছিয়ে যাচ্ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষিত শ্রীলঙ্কার চেয়েও নাজুক অবস্থায় রয়েছে খাতটি। দীর্ঘ দিন যাবৎই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে ব্যাংকের যেকোনো প্রকার ঝুঁকি সহন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অপর দিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্বলতা ফুটে উঠছে।

অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ

ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে পাকিস্তান যেখানে ১৬.৭ শতাংশ, ভারতে ১৬.৬ শতাংশ এমনকি সমস্যাকবলিত শ্রীলঙ্কা ১৬.৫ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সংরক্ষণ করেছে মাত্র ১১.০৮ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর ২০২১ সালের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা ছিল, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে; কিন্তু দীর্ঘ দিন যাবৎই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে ব্যাংকের যেকোনো প্রকার ঝুঁকি সহন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অপর দিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক দুর্বলতা ফুটে উঠছে। এতে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, মূলধন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকিং খাতের রেটিং খারাপ হবে। ফলে পণ্য আমদানিতে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। ফলে থার্ডপার্টি গ্যারান্টির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হবে। এতে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে। পরিস্থিতি উন্নতি করতে হলে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্কতার সাথে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

যাচাই ছাড়াই ঋণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়ায় ব্যাংকিং খাতে ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। আর এ ঋণখেলাপির কারণে ঋণের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ।

জানা গেছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বছরের পর বছর কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত মেনে নেবে। দুই বছরের পর মূলধন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংককে হয় মার্জার অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে যেতে হবে, অথবা বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হলে, তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কিভাবে মূলধন ঘাটতি পূরণ করবে তার পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে তা মনিটরিং করবে। এভাবে দুই বছর পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

সামগ্রিক অর্থনীতির দুর্বলতা ফুটে ওঠে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য রোডম্যাপ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চার বছর ব্যাপী রোডম্যাপ শেষ হতে চললেও ব্যাংকগুলো কাক্ষিত হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে ঊর্ধ্বমুখী খেলাপি ঋণ। আর এ খেলাপি ঋণের আধিক্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর বেশি। এ কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। ফলে মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। আর এর পুরো প্রভাব পড়েছে গোটা ব্যাংকিং খাতে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতিতে সামগ্রিক দুর্বলতাই ফুটে ওঠে। এর ফলে শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। বিদেশী বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর সাথে বিদেশী ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয় । এতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে গ্যারান্টি হিসেবে তাদের বাড়তি ফি দিতে হয়, যার প্রভাবে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যায়।

প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুন শেষে মূলধন সঙ্কট দেখা দিয়েছে দেশের ১২টি সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক বাংকে। ব্যাংকগুলো ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। এক দিকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, অপর দিকে মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকির মাত্রাও বেড়ে গেছে। গত জুন শেষে আলোচ্য ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি হয়েছে ২৯ হাজার ৩১ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছয়টি সরকারি ও ছয়টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকটি হলো বেঙ্গল ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় ও খেলাপি ঋণের আধিক্যের কারণে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে গেছে। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে কাক্সিক্ষত হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি এ ১২টি ব্যাংক।

বেসরকারি ব্যাংকেও রয়েছে মূলধন ঘাটতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, মূলধন ঘাটতিতে থাকা ১২ ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের দুই হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের এক হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের দুই হাজার ২৬১ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের দুই হাজার ৫০৭ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ১২৪ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১৩ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দুই হাজার ১৪৯ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে জুন শেষে।

অপর দিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দুই হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ২৯৯ কোটি টাকা, পদ্মা ব্যাংকের ২৬৩ কোটি টাকা এবং নতুন প্রজন্মের বেঙ্গল ব্যাংকের দুই কোটি ৩০ লাখ টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

Link copied!