ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম
ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের একটি হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। গত ১৫ জানুয়ারি এই কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় মৌলিক নীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে সেখান থেকে শুধু গণতন্ত্র রেখে বাকি তিন নীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে মৌলিক নীতির তালিকা থেকে বাদ দেয়া। এই বিষয়টি কিছু মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি জাপানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য ডিপ্লোম্যাটের দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক সুধা রামাচন্দ্রন।
ড. আলী রীয়াজের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন প্রস্তাবনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হলো? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতিকে বিভক্ত করার হাতিয়ার হিসেবে এবং গত এক দশকে স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা যা পূর্ববর্তী সরকার এবং এর সমর্থকদের দ্বারা বাংলাদেশে স্বীকৃত হয়েছে তা ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সহনশীলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন কমিশন বহুত্ববাদের সুপারিশ করেছে, যা দেশকে আরও বৃহৎভাবে ধর্মীয় সহনশীলতার অনুমতি দেবে। সংজ্ঞা অনুসারে বহুত্ববাদ বিভিন্ন পটভূমির মানুষের সহাবস্থানকে স্বীকার করে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এটি কেবল হিন্দু, বৌদ্ধ, আহমদী এবং বাহাইদের মতো ধর্মীয় বৈচিত্র্যকেই সম্বোধন করবে না, বরং দলিত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মতো অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও, কয়েক দশক ধরে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নির্বিঘ্নে চলেছিল।’
সাক্ষাৎকারে আলী রীয়াজের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বর্তমান সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সহাবস্থান করছে। কমিশনের প্রস্তাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ইসলামকে আগের জায়গাতেই রাখা হয়েছে। তাহলে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কেমন হবে?
এর জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, ‘১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে এবং ৮ বার সংবিধান সংশোধন করেছে, কিন্তু তারা কখনোই এটি বাতিলের উদ্যোগ নেয়নি। ২০২৪ সালের এপ্রিলে হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা সাংবিধানিক স্ববিরোধ সৃষ্টি করে না। আমরা যখন সমাজের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করেছি, তখন বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহালের পক্ষে মত দিয়েছেন। আমাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫০ হাজারেরও বেশি মতামত গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে বিপুলসংখ্যক মত ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে বহাল রাখার পক্ষে ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১২১টি দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করেছি, যার মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পর্যালোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, ১৯টি দেশে রাষ্ট্রধর্ম আছে এবং ৭৫টি দেশের সংবিধানে “সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস”–এর কথা উল্লেখ আছে। অনেক পশ্চিমা দেশেও একটি রাষ্ট্রধর্ম বা একক ধর্মের সরকারি স্বীকৃতি রয়েছে।’
এ সময় তিনি বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রধর্মের অবস্থান নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘২০১৭ সালে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার জানিয়েছিল, ৮০ টিরও বেশি দেশ একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে সমর্থন করে, যা সরকারিভাবে অনুমোদিত ধর্ম হিসেবে অথবা এক ধর্মকে অন্য ধর্মের তুলনায় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সমীক্ষায় তারা দেখেছে, ১৯৯টি দেশের মধ্যে ২২ শতাংশ দেশের একটি রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে এবং ২০ শতাংশ দেশ একটি ধর্মকে প্রাধান্য দেয়। সুতরাং, বাংলাদেশ কোনোভাবেই আলাদা নয়।’
রাষ্ট্র অনুমোদিত একটি ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্র এবং ধর্মের সম্পর্ক আলাদা হতে পারে বলে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘ইসরায়েলের বার ইলান ইউনিভার্সিটির ধর্ম ও রাষ্ট্র (আরএসএস) সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে জনাথন ফক্স বলেছিলেন যে, এ ধরনের পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন হতে পারে। তিনি যুক্তরাজ্য এবং ইরানকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উভয় দেশেই রাষ্ট্রধর্ম বা সরকারি গির্জা আছে, তবে এই দুই রাষ্ট্রের কার্যক্রমে ধর্মের ভূমিকা একেবারে বিপরীত।’
সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘(প্রস্তাব অনুযায়ী) সংশোধিত সংবিধানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক গত কয়েক দশকের মতোই থাকবে। যতক্ষণ না ধর্ম আইনগত ব্যবস্থার উৎস হিসেবে কাজ করছে অথবা রাজনৈতিক–আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে, ততক্ষণ উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। অনেক সময় রাষ্ট্রধর্মগুলো প্রতীকীভাবে বেশি দেখা যায়, এর বাস্তবিক প্রভাব থাকে কম।’
সামনের প্রক্রিয়াটি কী হতে পারে? প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কি নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে?
সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ে নিযুক্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদনগুলো সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ হওয়ার পর তা যাচাই করা হবে। তারপর সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনুস বলেছেন যে, সংলাপকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার নেতৃত্বে একটি ঐকমত্য কমিশন শিগগিরই নিয়োগ করা হবে। আশা করা যায়, দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ব্যবস্থা চিহ্নিত করে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়া শুরু হবে ফেব্রুয়ারিতে। এই আলোচনাগুলো থেকে বাস্তবায়নের একটি পথ বেরিয়ে আসবে।’