বাংলাদেশে আবারও আলোচনায় কিংস পার্টি। দেশের রাজনৈতিক বাঁক বদলের বিভিন্নক্ষণে বারবারই আলোচনায় এসেছে এই ধরনের রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসলেই, কিংস পার্টির তৎপরতা বেড়ে যায়। তবে শুধু যে অনির্বাচিত সরকারের সময়েই এই ধরনের রাজনৈতিক দল গজিয়ে ওঠে, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সেরকম নয়।
সাম্প্রতিক অতীতে নির্বাচিত সরকারের সময়েও কিংস পার্টির আনাগোনা বেশ চোখে পড়েছে। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কিংস পার্টিগুলো এবং তাদের নেতারা বেশ গুরুত্ব পেয়েছিলেন। তবে বরাবরের মতোই ভোটের মাঠে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেননি। জনগণের দারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছেন।
তাই ভোটের আগে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিংস পার্টির নেতারা যতোটা সক্রিয় থাকেন, ঠিক উল্টোটা ঘটে ভোটের পর- একেবারেইু নিষ্প্রভ হয়ে যান এরা।
গত পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দেয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা। আর এই সুযোগে অবধারিতভাবেই, আবারও আলোচনায় এসেছে, দেশের রাজনীতির সেই পুরোনো খেলা, কিংস পার্টি গঠন।
এরি মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে যে, নতুন করে গঠন করা হচ্ছে কিংস পার্টি। শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের সাংগঠনিক শাখাপ্রশাখা বিস্তারের কাজ শুরু দিয়েছে। গঠন করা হয়েছে আরেকটি প্ল্যাটফর্ম নাগরিক কমিটি। এই কমিটিও দেশব্যাপী শাখাপ্রশাখা বিস্তারের কাজ করে যাচ্ছে।
নতুন যে শক্তি আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, সেটিকেই কিংস পার্টি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। যদিও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের পক্ষ কিংস পার্টি গঠনের কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতার প্রশ্রয়ে নতুন করে গড়ে ওঠা কোনো রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশে কি সফল হতে পারবে? অতীত ইতিহাসই বা কি? বাংলাদেশে তাদের সফলতা বা ব্যর্থতা কেমন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আমরা। তবে তার আগে বাংলাদেশে কিংস পার্টির তৎপরতার ইতিহাস দেখে আসি।
কিংস পার্টি কি?
এই প্রশ্নের উত্তরে সহজে বলতে হবে, কিংস পার্টি ধারণাটি মূলত পশ্চিমাদের থেকে নেয়া। এই ধরনের রাজনৈতিক দলের মাঠ পর্যায়ের সংজ্ঞা দিতে গেলে বলতে হয়, নানা কারণে- যেমন বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, জরুরি অবস্থার মতো ঘটনা ঘটলে অথবা, সামরিক কিংবা অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসলে, সেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের ছত্রছায়ায় নব্য রাজনৈতিক দলের জন্ম দেয়া। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোকেই ডাকা হয় পিপলস পার্টি হিসেবে।
এই ধরনের রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্যই থাকে ক্ষমতাসীন শাসকদলকে বৈধতা দেয়া। মানে কিংস পার্টি ক্ষমতায় থাক আর ক্ষমতার বাইরে থাক, যাদের ছত্রছায়ায় তাদের বিকাশ ঘটেছে, তাদের বৈধতা দেয়াই এই কিংস পার্টির লক্ষ্য।
বাংলাদেশে কিংস পার্টি গঠনের ইতিহাস কয়েকদশকের পুরোনো। ক্ষমতার থাকা অবস্থায় সাবেক দুই সেনাশাসক জিয়া্উর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিএনপি ও জাতীয় পার্টি গঠন করেন। এই ধরনের তৎপরতা বড় আকারে দেখা যায় ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের সময়।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন সেই ভোটে, তার নিজের দল জাতীয় পার্টি ছাড়া কার্যত বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিলো না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবিসহ প্রধান বিরোধীদলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। একইসঙ্গে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তারপরও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯টি দল অংশ নেয়। কীভাবে অংশ নেয়, সেখানেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশে কিংস পার্টি গঠনের অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা।
যে কোনোভাবেই হোক, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে- এই বাসনা থেকেই এরশাদ তখন এঁটেছিলেন নতুন ফন্দি। প্রতিদ্বন্দ্বী না পেয়ে তিনি মাঠে নামিয়ে দেন জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবকে। তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় একটি সাজানো রাজনৈতিক মোর্চা, যা পরিচিত ছিলো- সমন্বিত প্রতিদ্বন্দ্বী জোট বা কপ নামে।
সেই নির্বাচনে রবের নেতৃত্বাধীন কপ ১৯টি আসন পেয়ে সরকারের অনুগত হিসেবে সংসদে বিরোধীদলের মর্যাদা পায়। এরশাদ সরকারের পতনের পর সেই কপ ভেঙে যায়। পরে আর কখনো তাদের রাজনীতির ময়দানে পাওয়া যায়নি।
এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালে তিনটি সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় কিংস পার্টি গঠনের তৎপরতা দেখা যায়নি।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায়, ২০০৭ সালের ওয়ানে ইলেভেনের পর। ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরই দৃশ্যপটে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কিংস পার্টি গঠনের তৎপরতা। তখনকার সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনীতিতে আলোচিত মুখ ছিলেন বিএনপির সাবেক নেতা প্রয়াত ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী। তিনি গঠন করেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি বা পিডিপি। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়ে ভোটেও অংশ নেয় দলটি। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। ওই নির্বাচনে কিংস পার্টি পিডিপির ২১ জন প্রার্থী মিলে মোট ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ১৪ হাজার ২২৮টি। এরপরই কার্যত গুটিয়ে যায় কোরেশীর পিডিপি।
ওয়ান ইলেভেনের সময় গজিয়ে ওঠা আরেক আলোচিত রাজনৈতিক দল হলো বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। দেশে জরুরি অবস্থার সময় ব্যাপক সরগমর থাকলেও ভোটের মাঠে কার্যত কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি কল্যাণ পার্টি।
ওয়ান ইলেভেনের সময় আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল বেশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী ফারুক আহম্মদের ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি বা এনপিপি এবং জাগপার প্রয়াত নেতা শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বাধীন কিংস পার্টি পরিচিতি লাভ করে। তবে কার্যত তারা রাজনীতির মাঠে নিজেদের স্বাক্ষর রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
এরপর ২০০৯ সাল থেকে দেশ পরিচালনা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সরকার। তবে আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ব্যানারে সরকার পরিচালিত হলেও, কার্যত সেটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপ নেয়। তাই এই সময়েও দেখা দেয় কিংস পার্টির তৎপরতা।
২০১৪ সালের নির্বাচনের কয়েকদিন আগে নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট বা বিএনএফ। বিএনপি থেকে বেরিয়ে ওই দল গঠন করে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজমুল হুদা এবং বিএনপির একসময়ের নেতা আবুল কালাম আজাদ। ৫ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন ভোটে অংশ নিয়ে বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ ঢাকা-১৭ আসনে বিজয়ী হন, যা তখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঢেউ তোলে।
এরপর ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পায় তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএম। বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা তখন বলেছিলেন, এই দলগুলোর মাধ্যমে বিরোধী শিবিরে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে সরকার।
তবে দুই দলের নেতারা নানা কথা বলে আলোচনার জন্ম দিলেও শেষ পর্যন্ত সাড়া ফেলার মতো কিছু ঘটাতে পারেনি। ইসির হিসাব অনুযায়ী, বিএনএমের প্রার্থী দেয় ৫৪টি আসনে। তৃণমূল বিএনপির হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন ১৩৫টি আসনে। তবে ভোটের মাঠে কোনো দাপটই দেখাতে পারেননি তারা।
স্বাভাবিকভাবেই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কিংস পার্টি বলে পরিচিতি রাজনৈতিক দলগঠনের পেছনে থাকে সরকার। বিরোধী দলগুলো থেকে লোক ভাগিয়ে এসব দলে আনার চেষ্টা করা হয়। আর প্রধান বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন, মামলা দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হয়। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে ও ভোটার বাড়াতে কিংস পার্টিখ্যাত নতুন দল গঠন করা হয়।
ছাত্ররা কি কিংস পার্টি করতে যাচ্ছে
শেখ হাসিনার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খুব শিগগিরই গঠিত হতে পারে নতুন রাজনৈতিক দল। এরি মধ্যে থানা পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই দুটি পক্ষই অরাজনৈতিক ফোরাম হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলটি নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে। চাইলে ওই দুইটি ফোরাম থেকে যে কেউ নতুন দলে যোগ দিতে পারবেন।
এদিকে নতুন যে কোনো রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানাতে চান রাজনৈতিক নেতারা। তবে সরকারের ছত্রছায়ায় কোনো রাজনৈতিক দল হলে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে বলে মনে করছেন তারা।
সরকারের ছত্রছায়ায় নতুন দল গঠিত হলে তা কি সফল হবে, নাকি অতীতের মতোই কালের গহ্বরে বিলীন হবে- তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
তব ছাত্রদের পক্ষ থেকে কিংস পার্টি গঠনের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। তরুণদের নিয়ে সবেমাত্র আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী প্রথম আলোকে বলেছেন, তারা কোনো কিংস পার্টি গঠন করছেন না। কারণ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা নেই। উপদেষ্টা পরিষদে যাঁরা আছেন, তাঁদের কি দল করার ইচ্ছা আছে- এ প্রশ্ন তুলেছেন তরুণ নেতা।
তিনি আরও বলেন, যে সরকার গঠিত হয়েছে, সরকারপ্রধান কি কোনো দলের? জিয়াউর রহমান একটা দল গঠন করতে চেয়েছিলেন। যাঁর জন্য একটা কিংস পার্টি হয়েছিল—বিএনপি। সরকারে বসে তিনি এটি করেছেন। বিএনপি যে কিংস পার্টি, এটা তো অস্বীকার করার জো নেই।