সফটওয়্যার কিনে ব্যবহার করার জিনিস না! এত টাকা দিয়ে কম্পিউটার কিনে আবার যদি সফটওয়্যার কিনতে হয় তাহলে তো আমাদের মত অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা কম্পিউটারই ব্যবহার করতে পারবে না।
কথাগুলো বলছিলেন হাতিরঝিলে বসে থাকা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একঝাঁক তরুণ।
সফটওয়্যার এর নানাদিক নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সঙ্গে কথা বলেছেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
দ্য রিপোর্ট: সফটওয়্যার কিনে কেউ ব্যবহার করছে না এটার পেছনের কারণটা আপনার মতে কি?
মোস্তাফা জব্বার: আমাদের দেশে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা। মেধাস্বত্ব বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বিসৃত জিনিস। কোন আবিষ্কার, উদ্ভাবন রক্ষা করা হয় পেটেন্ট করে। আর পেটেন্টের জায়গাটা হচ্ছে কোন আবিষ্কার উদ্ভাবন যে করেছে তার মেধাস্বত্ব অর্থাৎ মেধাগত একটা সম্পদ।
বই শিল্পজাত জিনিস কিন্তু সফটওয়্যার কপিরাইট হয়। আমাদের দেশের মানুষের বড় সমস্যা হলো তারা মেধাসম্পদ বোঝে না। মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জনগণ দেয় না। একারণে সবচেয়ে ভোগান্তির জায়গা সফটওয়্যার এর ক্ষেত্রে।
সফটওয়ারের মেধাস্বত্ব বিশ্ব স্বীকৃত। বাংলাদেশে কপিরাইট আইন রয়েছে ২০০০ সাল থেকে, এই কপিরাইট আইনে সফটওয়্যার মেধাস্বত্ব হিসেবে স্বীকৃত। আবার দেশের সফটওয়্যার তো জনগণ মানে না, আন্তর্জাতিকভাবে যে সফটওয়্যারগুলো আছে সেগুলোর কপিরাইটও মানে না। বিজয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম হয়েছে। এটা যে কারও মেধাস্বত্ব আর সেই মেধাস্বত্ব মেনে, তার যথাযথ মূল্য দিয়ে কেনা উচিত, এই ধারণাটাই আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি।
আমি প্রথমদিকে যখন বিজয়ের উদ্ভাবন করি, ১৯৯৩ সালের ২৬শে মার্চ পর্যন্ত আমি এটা বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। যে কম্পিউটারে এগুলো ব্যবহার করা হতো, সেগুলো আমি বিক্রি করতাম। কম্পিউটারের সাথে ফ্রী দিয়ে দিতাম। আমার সফটওয়্যারের দাম কম্পিউটারের দামের সাথে যোগ করে পেয়ে যেতাম।
প্রথমদিকে সফটওয়্যার খুব ভালো বিক্রি হয়েছে। এখনো যে বিক্রি হয়না তা নয়। কিন্তু দুই ধরনের মানুষ আমাদের এই সফটওয়্যারের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে যাচ্ছে। একটি হচ্ছে পাইরেসি বা নকল করা। এটা মেধাস্বত্বের অধিকারী যে তার ন্যায্য পাওনা টাকা না দেওয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে নকশা নকল করে আরো অনেক সফটওয়্যার তৈরি করা।
দ্য রিপোর্ট: সফটওয়্যার ফ্রি দেওয়া হয় না কেন?
মোস্তাফা জব্বার: এখন অনেকেই বলেন যে অনেক সফটওয়্যার ফ্রি পাওয়া যায়, আপনি ফ্রি দেবেন না কেন। আসলে সফটওয়্যার তৈরি করতেও কিন্তু ব্যয় করতে হয়। আবার এই সকল সফটওয়্যার আপডেট করতেও জনবল রাখতে হয়। আমার বিজয় সফটওয়্যার যেটা উইন্ডোজের জন্য সেটি মাত্র ৪০০ টাকা।
দ্য রিপোর্ট: কম্পিউটার বিক্রেতারা পাইরেটেড সফটওয়্যার নিতে উৎসাহিত করছে। আপনার কী মনে হয়?
মোস্তাফা জব্বার: পাইরেসির ইতিহাসটা খুব সহজ ইতিহাস, আমাদের দেশে যখন কম্পিউটার আসলো এটাতো শুধুমাত্র একটা যন্ত্র। এই যন্ত্র ব্যবহার করতে সফটওয়্যার লাগবে। কম্পিউটার বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সফটওয়ারগুলো ফ্রীতে দেওয়া শুরু করলো। পাইরেসি করে বিতরণ করে বেড়াতো।
কারণ হল সে সময় দেশের মানুষের কম্পিউটার কেনার সক্ষমতা কম ছিলো ফলে বিক্রেতারা নিজেরাও পাইরেসি করে।
কিন্তু আজ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যখন নিজেরাই সফটওয়্যার তৈরি করছে, সরকারের অগ্রাধিকারে যখন সফটওয়্যার প্রস্তুত খাত গুরুত্ব পাচ্ছে, ঠিক এই সময়েও বাংলাদেশের কম্পিউটার বিক্রেতারা পাইরেটেড সফটওয়্যার নিতে ক্রেতাদের উৎসাহিত করছে।
পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল কিংবা সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যবহারকারীদের এখনও যথেষ্ট সচেতন করে তোলা যায়নি। পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকেই যায়।
দ্য রিপোর্ট: বিজয়ের অর্জন কি?
মোস্তাফা জব্বার: আমি মনে করি, বাংলা ভাষার জন্য আমি একটা অসাধারণ কাজ করে দিয়েছি। বাংলা ভাষায় মোট ৪৫৪টি অক্ষর আছে। এক সময় পত্রিকা বের করতে এই ৪৫৪টা অক্ষর মনে রেখে কম্পোজ করতে হতো। এই অক্ষরগুলো ফেলে দেয়া যাবে না। ফেলে দিলে বাংলা ভাষা থাকবে না। এই অক্ষরগুলোকে আমি ৫৫টা অক্ষরে নিয়ে এসেছি। এই যে ৫৫ অক্ষরে বাংলা লেখা, অবিকৃতভাবে এবং কোন রকম একটি অক্ষরকেও বাদ না দিয়ে করা- এটাই বিজয়ের অর্জন। বিজয় ছাড়া আর কোন রকমের প্রযুক্তিতে এই কাজটি করা সম্ভব হয়নি।
বিজয় আমার অস্তিত্ব, লড়াই এবং অর্জন। কষ্টের দিক আছে সফলতার দিকও আছে। বাংলা ভাষা এখন আর শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষে ইন্টারনেট দুনিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতিটি শব্দ।
কম্পিউটার ছাড়াও মুঠোফোনে আমরা বাংলায় লিখছি, পড়ছি। কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রচলনেরও একটি ইতিহাস আছে।
বর্তমানে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারে বাংলার ব্যবহার অনেক বেড়েছে। গুগলে বাংলায় অনুসন্ধানে তথ্যের পাশাপাশি এখন ছবিও নিমিষেই হাজির হচ্ছে। বাংলা অনলাইনে বাড়ছে দৈনিকের পাঠকও। ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা সংবাদপত্রগুলো চালু হওয়ার পর ওয়েবে বাংলা আগের তুলনায় বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
সফটওয়্যার পাইরেসির ফলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্যবহারকারী নানাবিধ সমস্যায় পড়তে পারে। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পাইরেটেড সফটওয়্যারের জন্য কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা হয় না। তাই আপডেট বা আপগ্রেড করার সুবিধা, নতুন অংশের সংযোজন প্রভৃতি করা যায় না।
এছাড়াও পাইরেটেড সফটওয়্যার ভাইরাস বহন করতে পারে অথবা একবারে কাজ নাও করতে পারে। লাইসেন্সবিহীন সফটওয়্যারে যথাযথ ডকুমেন্টশন থাকে না। কোন প্রতিষ্ঠানে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করলে ঐ প্রতিষ্ঠানের পণ্য দ্রব্যাদি কিংবা সেবার মান ব্যহত হয়। পাইরেটেড সফটওয়্যারে অনেক সময় ভার্ষন কন্ট্রোল করার ব্যবস্থা দেয়া থাকে না, যার ফলে ব্যবহারকারীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয় এবং সফলতার হার কমে যায়।
আবার আইনসঙ্গত (Legitimate) ব্যবহারকারীরাও পড়েন আর্থিক সমস্যায়। পাইরেসির ফলে রাষ্ট্র বা সরকার ট্যাক্স বা ভ্যাট আদায় থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দ্য রিপোর্ট: আপনার গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।
মোস্তাফা জব্বার: আপনাকেও ধন্যবাদ।