মেয়েরা গল্প লিখছেন শুনে উনিশ শতকের প্রায় আশি শতাংশ পুরুষের মনোভাব ছিল ‘আরশোলার পাখি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।’ বাংলার প্রথম আত্মকথার লেখিকা রাসসুন্দরী দেবী স্বামীর ঘোড়াকে দেখে ঘোমটা দিতেন – উনিশ শতকে সংসারে নারীর অবস্থানের চিত্রটি ছিল এরকমই। একবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পৌঁছেও পুরুষশাসিত সমাজের কতজন পুরুষ সাফল্যের শীর্ষে ওঠা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর স্বীকৃতি দিতে পারে?
নানাভাবে নারীর সাফল্যকে তুচ্ছ, খাটো করার চেষ্টা করে থাকে পুরুষ। সাফল্যের কথা যদি বাদও দিই, মেয়েদের যে একটা আলাদা আত্মপরিচয় আছে, ধারণক্ষমতা আছে, নিজস্ব আকাঙ্খার জগৎ আছে, তারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, নারী জীবনের এই সহজ, সাধারণ সত্যকে পুরুষ অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যই করে এসেছে চিরকাল। নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য আর অপমান আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্গত হয়ে গেছে। কথা প্রসঙ্গে আলবেয়ার কামু একবার সিমোন দ্য বোভোয়ার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘নারীর পিছিয়ে থাকার কারণে পুরুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি, কারণ তারা উপযুক্ত সঙ্গিনী পায় না।’ এই যে সঙ্গিনী পায় না, আমাদের সমাজে সেই অবস্থার বদল ঘটেছে কি সেভাবে? পুরোপুরি বদল না ঘটলেও সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে নারীদের। আর এটা সম্ভব হয়েছে নারীদের জেগে উঠবার কারণেই। এই জাগরণ একদিনে ঘটেনি।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের দিকে দিকে এদিন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা যে মহান আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তার স্মরণেই প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়। হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের সেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। এতে বহু নারী শ্রমিক আহত ও গ্রেফতার হন। উপযুক্ত বেতন, কাজের উন্নত পরিবেশ এবং ১০ ঘণ্টা কর্মদিবস এবং অভিবাসি ও কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে যে আন্দোলন সেদিন হয়েছিল, সেই সোচ্চার ধ্বণিই যেন নারী অধিকারের বার্তা নিয়ে আসে প্রতিবছর।
তারই পথ ধরে ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রম সময়ের দাবিতে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক মে দিবসের রক্তাক্ত শ্রমিক অভ্যুত্থান। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে ফেডরিখ এঙ্গেলসের উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমানাধিকারের দাবিকে প্রধান করে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্য অনুপ্রাণিত করে শ্রমজীবী ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদেরকে। নারী আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯০৮ সালে ভোটাধিকারের দাবিতে নিউইয়র্কের নারী দর্জি শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানায় কর্মবিরতি এবং ধর্মঘট পালন করেন। ঐতিহাসিক এই আন্দোলনের ফলে ১৯০৯ সালে নারী শ্রমিকদের সভায় নারীর ভোটাধিকারের দাবি প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করা হয়। নারী আন্দোলনের চেতনাকে ধরে রাখার জন্য ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ঐতিহাসিক ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করেন। মহামতি লেনিন-এর উদ্যোগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অপরাপর সদস্যবৃন্দ সেই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। ফলে সর্বসম্মতভাবে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে গৃহিত হয়। তখন থেকে এই দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে।
নারীর পেশাগত অবস্থান
আজ আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ১১২তম দিবস পালন করছি। এই সময়ে বলাই যায়, নারীরা অনেকদূর এগিয়েছে। সমাজের বিভিন্ন পেশায় নারীদের অবস্থান লক্ষ্যণীয়। তারপরও প্রশ্ন ওঠে, যখন দেখা যায় পেশাগত ক্ষেত্রে নারীদের নানা কারণে পিছিয়ে দেওয়া হয় তুচ্ছ অযুহাতে।
আজও আমাদের দেশে ৮০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্ট শ্রমিক যার সিংহভাগ নারী শ্রমিক নূন্যতম মজুরি, কর্মপরিবেশ, মাতৃত্বকালীন ছুটির দাবিতে প্রায়ই আন্দোলন করেন। অনেক সময় পুড়ে মরছেন। জীবনের নেই কোনো নিরাপত্তা। আবার অন্যদিকে নারী হিসাবে কারখানায়, পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নেই তাদের মর্যাদা।
পেশা নির্বাচনেও নারীকে পদে পদে সমস্যায় পড়তে হয়। চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীকে দেখতে সমাজ অভ্যস্ত না। পুলিশ, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ায় ইত্যাদি পেশায় নারীরা নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ করে।
পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানে নারী
শুধু পেশাগত ক্ষেত্রে নয়, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও নারীকে অনেকসময় হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। আড়াই বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা, কেউই নির্যাতন-নিপীড়নের বাইরে থাকছে না। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের ছবি তুলে মোবাইল বা ইন্টারনেটে ছেড়ে ব্লাকমেইল করা, যৌতুকের জন্য হত্যা, প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এসিড ও ছুরি মারা– নিত্যদিনের ঘটনার শিকার নারীরা। নিজ পরিবারে, রাস্তা-ঘাট, কর্মস্থলে কোথাও নারী নিরাপদ নন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, প্রায় ১৬.২ ভাগ নারী কর্মস্থলে এবং ৮৭.৭ ভাগ নারী নিজ পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতিবছর ২০ থেকে ৫০ হাজার নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে, যার অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়ে যায়। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশী।
সমাধান কোন পথে
এ সকল নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার বা শাস্তি হয় না। আসামীরা সরকার-প্রসাশনের প্রশ্রয়ে বা অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে ছাড়া পেয়ে যায়। শুধু বিচার প্রক্রিয়া নয়, নারী নির্যাতন সমূলে উৎপাটনের জন্য প্রয়োজন নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অশ্লীলতা-অপসংস্কৃতি ডেকে আনছে অবক্ষয়। সারাদেশে পর্নোগ্রাফি কিশোর-যুবকদের মধ্যে এক ভয়াল বিকৃতি ডেকে আনছে। এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস কেবল সমাজের কিছু নারীর সুবিধা আদায়ের জন্য গড়ে ওঠেনি। এ দিবসের মূল চেতনা হল সকল প্রকার বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়ন থেকে নারীদের এবং চূড়ান্ত বিচারে সমাজকে মুক্ত করা। আলবেয়ার কামু যেমনটা বলেছেন তার সাথে সুর মিলিয়ে বলা যায়, নারীকে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা যখন বন্ধ হবে, তখন শুধু পুরুষরাই নয়, নারীরাও এগুবে, এগিয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্বও।