বিরলপ্রজ এক লেখক ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি ছিলেন সেই লেখক, লেখার জন্য যাঁকে রক্ত দিতে হয়েছে। এমনকি যাঁকে দিতে হয়েছে প্রাণও। তিনি সব সময়ই সাহসী ছিলেন। নিন্দাবাদের ভয়ে ভীত ছিলেন না মোটেও। একজন লেখকের জন্য এটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। হুমায়ুনের ভেতরে সৎ সাহসের কমতি ছিল না কখনো।
বাংলা ভাষার এক নিরন্তর সংগ্রামী অভিযাত্রী
আমাদের দেশে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবী ভয়াবহ রকমের সংখ্যালঘু। হাতে গোনাই বলা চলে। কারণ বুদ্ধিজীবী নির্ভয়ে মত প্রকাশ করে সরকার কিংবা ক্ষমতাশালী, উগ্রবাদীদের চক্ষুশূল হতে চান না। আর যারাই সত্য উচ্চারণ করেছেন তারা পদে পদে বাধা বিপত্তির শিকার হয়েছেন।
শাসক, সমাজের মোড়ল ও ধর্মান্ধদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্যি কথাটি বলার মতো ছিলেন খুবই নগণ্য সংখ্যক বুদ্ধিজীবী। অধ্যাপক আহমদ শরীফ, দাউদ হায়দার, শামসুর রাহমানকে হুমকি-ধামকিও প্রচুর দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি তো কবি শামসুর রাহমানের ঢাকার শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিল দুর্বৃত্তরা। অবশ্য গুরুতর আহত হয়েও কবি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে হুমায়ুন আজাদের উপর। তার বই যেমন নিষিদ্ধ হয়েছে, তাকে অজস্র গালাগাল, মানসিক আঘাত সইতে হয়েছে। এবং সর্বশেষ তাকে তো শারীরিকভাবে আঘাত করে মৃত্যুর মুখেই ঠেলে দিয়েছিল উগ্রবাদীরা। তিনি জানতেন আঘাত আসবে কিন্তু তবু তিনি টলেননি। তাই স্রোতের প্রতিকূলে চলে সত্য ভাষ্যের এক অনন্য পথিক হুমায়ুন আজাদ।
১৯৮৫ সালে কবি শামসুর রাহমানের বাসায় শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও সালেহ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
হুমায়ুন আজাদের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের কামারগাঁয়ে নানা বাড়িতে। যেটি বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার অন্তর্গত। তাঁর জন্ম নাম ছিল হুমায়ুন কবীর।তাঁর বাবা আবদুর রাশেদ প্রথম জীবনে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, পরে পোস্টমাস্টার এবং ব্যবসায়ী হয়েছিলেন। মা জোবেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র। হুমায়ুন আজাদের বেড়ে উঠা তাদের বাড়ি রাঢ়ীখাল গ্রামে। তাঁর শৈশব ছিল অসম্ভব সুন্দর। রাঢ়ীখাল গ্রামের কাছেই পদ্মা নদী। রাতের বেলায় নদীতে স্টিমার চলত, তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন। নিজে লিখেছিলেন স্টিমারের আওয়াজ আমার কাছে অলৌকিক মনে হতো, তাই আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম অলৌকিক ইস্টিমার। তাঁর সমুদয় লেখায় সংস্কারবিরোধীতা উঠে এসেছে। মানুষের চিন্তার পরিধি বাড়ানোর জন্য নিরন্তর তিনি লিখেছেন। এ দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর ছিল অপরিসীম ভাল লাগা ও ভালবাসা।
হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন ২৮ এপ্রিল। তাঁর জন্ম দিবসে এই লেখায় চকিতে তাঁর মনোজগৎ বিশ্লেষণের প্রয়াস নেওয়া যাক।
হুমায়ুন আজাদ ছিলেন সেই লেখক, লেখার জন্য যাঁকে রক্ত দিতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীরা তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে, যা এই লেখককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ুন আজাদের চরিত্রের নানা দিক নিয়ে কথা বলা যায়। যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের জন্য সেটা সহজও বটে। তবে আমরা, যাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না, আদতে দেখাদেখি হয়নি কখনো, তাদের জন্য এ ক্ষেত্রে অন্যের স্মৃতির ওপর নির্ভর করাই হয়তো বড় অবলম্বন। অনেকের আলাপে—চঞ্চল আশরাফ, কুমার চক্রবর্তী, তাঁর মেয়ে মৌলি আজাদ বা অনুপ সাদির বইয়ে তাঁর ব্যাপারে নানান কথা পাওয়া যায়। এর বাইরে তাঁকে নিয়ে নিন্দাবাদ আছে, যেহেতু আলাপ–সালাপে তিনি ছিলেন ঠোঁটকাটা, কথায় ছিলেন অনমনীয়।
হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন। নির্ভীকভাবেই লিখে গেছেন। তাঁর লেখা পড়ে উজ্জীবিত হয়েছেন অনেক তরুণ, তর্ক করতে শিখেছেন অনেকে—এসব নতুন কোনো কথা নয়। নতুন কথা হলো, লেখাটা আজকের বাস্তবতায় অতটা নিরাপদ নয়। আমি–আপনি যা বলতে চাই, তা পুরোপুরি বললে বা খালাস করলে অনেক ‘বিপদ’ই ঘটতে পারে। কিন্তু এই সব বিপদের ভেতর বাস করেই হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, লিখতেন। তোষণের ধার ধারতেন না। এ জন্য তাঁর প্রতি নত হতে হয়, হইও।
তবে হুমায়ুন আজাদ সমীপে আমার বিস্তর নালিশ আছে। নালিশের শুরু তাঁর অন্ধ ইউরোপাচ্ছন্নতা নিয়ে। তাঁকে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, ব্যক্তিজীবনে এ লেখকের স্বপ্নভূমি ছিল ইউরোপ তথা ইউরোপের আদর্শ। তিনি মনে করতেন, দুনিয়ার যা কিছু ভালো, তা ইউরোপ থেকে এসেছে। শোচনীয়ভাবে (শোচনীয় হুমায়ুন আজাদের প্রিয় শব্দগুলোর একটা) তিনি তথাকথিত ‘সভ্যতা’র ভোক্তা ছিলেন। যে চাবিশব্দের ওপর দাঁড়িয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল আমাদের বইতে হয়েছে, সেখানে তিনি কেন ‘ক্রিটিক্যাল’ হতে পারলেন না, তা ভেবে এখন আশ্চর্য লাগে! পুঁজির আগ্রাসন নিয়ে তিনি সচেতন ছিলেন বলেই মনে হয়, কিন্তু ইউরোপ–আমেরিকার আগ্রাসন বিষয়ে তাঁকে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখা যায়নি। বরং এসব ক্ষেত্রে তিনি প্রশংসাই করে গেছেন। ভাগ্যিস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া বা ডন ট্রাম্পের মুখ কিংবা ন্যাটোর বহু যুদ্ধ, আফগানিস্তানের পরিণতি, ইরাকের পরিণতি বা আফ্রো-এশিয়ার তথাকথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের সবটা অর্থাৎ ইউরোপ–আমেরিকার এখনকার মুখ তাঁকে দেখতে হয়নি!
দেখলেই কি চিন্তার ধরন বদলাতেন হুমায়ুন আজাদ?
তাঁর সময়েই তো ‘উত্তর আধুনিকতা’ চিন্তার জগতে প্রধান প্রপঞ্চগুলোর একটি হয়ে ওঠে। কিন্তু তিনি আধুনিকতা থেকে নড়েননি। রাগী বৃষের মতো আঁকড়ে ছিলেন, আর অন্য সব মতের দিকে লাল পতাকা দেখার মতো করেই রাগী রাগী বাক্য ব্যয় করেছেন। এখন মেকওলে সাহেব যে কথা বলে বেড়াতেন, তা একবার মনে করা যাক।প্রাচ্যবিদ্যার অনেক বিশারদের সঙ্গেই তাঁর আলাপ হয়েছে। কিন্তু এমন একজনেরও সাক্ষাৎ পাননি, যিনি স্বীকার করতে পেরেছেন যে সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় রচিত সব সাহিত্যের মূল্য যেকোনো ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটিমাত্র আলমারিতে রাখা বইয়ের দামের চেয়ে বেশি হবে। আমার মনে হয়, প্রাচ্য সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের ধারণা অন্তত আট আনা এমনই ছিল। ফলে তিনি প্রায় কখনোই, আমার যা চোখে পড়েছে, উপনিবেশ নিয়ে ক্রিটিক্যাল হতে পারেননি।
ধর্মের ব্যপারেও তাঁকে খুব একটা সমালোচকের জায়গায় দেখতে পাই না। এখানে তাঁর ভূমিকা ছিল অনেকটাই ‘নিন্দুক’–এর। তাঁর ব্যাপারে হয়তো ধর্মান্ধ মানুষজনের মাথাব্যথা ছিল, কিন্তু এর বাইরে তিনি আসলে তীব্র নিন্দাই করে গেছেন। আর নিন্দা করে গেছেন সেনাশাসনের। এই দুই বিষয়কে একটু রাজনৈতিক জায়গা থেকে দেখলে সম্ভবত লেখক হুমায়ুন আজাদের মনের কিছুটা তল খুঁজে পাওয়া যাবে।
হুমায়ুন আজাদ যখন লিখতে শুরু করেছেন অথবা তার আরও খানিক আগে থেকেও যদি দেখা যায়, দেখা যাবে, দেশে চলছে ধর্মের নৈতিকতা আর সেনা-দেশপ্রেমের শাসন। সেটা পাকিস্তান পর্ব থেকে শুরু করে ১৯৯০–এর গণ–আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এরশাদের পতন পর্যন্ত এবং এরপরেও পরিবর্তন বিশেষ হয়নি, উর্দির দৃশ্যমানতা কিছুটা হ্রাস পাওয়া ছাড়া। কিন্তু এই যে মানুষের ওপর অত্যাচার চলছে আইয়ুব খান থেকে এরশাদ পর্যন্ত—এ সময়ই তাঁর বেড়ে ওঠা ও বিকাশ। এ সময় ধর্মের নামে পাকিস্তানি শাসন থেকে রাষ্ট্রধর্ম বা একে ব্যবহার করে যে হরেক পদের ‘নখরামি’ হয়েছে, মানুষের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এ জন্যই তিনি ধর্মান্ধতা ও সেনাশাসনের প্রতি বিরক্ত ছিলেন। হয়তো এসব কারণেই তিনি আঁকড়ে ছিলেন ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট থেকে প্রাপ্ত আধুনিকতাকে।
কবিতামগ্ন এক মানুষ
সারা জীবন যা কিছু করেছেন, তার সবার আগে রেখেছেন কবিতা। কবি পরিচয়ের প্রতিই ছিলেন সবচেয়ে দুর্বল। কবিতা সম্পাদনা ও বাছাইয়ের কাজ ছিল প্রিয়। রবীন্দ্রনাথের প্রধান কবিতা বা আধুনিক কবিতার সংকলন তার নমুনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’র সংকলন করে তিনি এক হুলুস্থুল করে গেছেন, যার আলোচনা এখনো বিরাজমান। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আধুনিক বাংলা কবিতার মূল্যায়ন যেন হুমায়ুন আজাদের সংকলনকে আদর্শ ধরে করা—হয় তার পক্ষে নয়তো বিপক্ষে। যাঁদের তিনি তাঁর সংকলনে স্থান দেননি, তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদসহ আমার একাধিক পছন্দের কবি রয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ তাঁদের আধুনিক হিসেবে অস্বীকারও করছেন, এমন নয়। কিন্তু তিনি তাঁদের নিচ্ছেন না, নিতে পারছেন না। এর কারণ কী?
কারণটি জানার জন্য চোখ রাখা যাক তাঁর নিজের ভাষ্যে, ‘এখানে সক্রিয় অজস্র কবিযশোপ্রার্থীর মধ্যে তাঁদেরই নিয়েছি, যাঁরা কবি; তবে কয়েকজনকে নিই নি, সেটা আমাদের সময়ের শোচনীয় দুর্ভাগ্য—সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা নিই নি, আমি নিতে পারি না, কেননা তাঁরা সামরিক একনায়কত্ব ও মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণ ক’রে মানুষ ও কবিতা ও আধুনিকতার বিপক্ষে চ’লে গেছেন। এ-সংকলনটিকে আমি ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যেতে চাই, এক শতক পর আমার মতো কেউ এটি বিচার করবেন।
আধুনিক কবি ও কবিতা শনাক্তিতে আমি কতোটা ব্যর্থ হয়েছি।’
নিজের বুঝের প্রতি তাঁর এমন আত্মবিশ্বাস আদতে মুগ্ধতা জাগানিয়াই।
‘এখানে সক্রিয় অজস্র কবিযশোপ্রার্থীর মধ্যে তাঁদেরই নিয়েছি, যাঁরা কবি; তবে কয়েকজনকে নিই নি, সেটা আমাদের সময়ের শোচনীয় দুর্ভাগ্য—সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা নিই নি, আমি নিতে পারি না, কেননা তাঁরা সামরিক একনায়কত্ব ও মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণ ক’রে মানুষ ও কবিতা ও আধুনিকতার বিপক্ষে চ’লে গেছেন। এ-সংকলনটিকে আমি ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যেতে চাই, এক শতক পর আমার মতো কেউ এটি বিচার করবেন। আধুনিক কবি ও কবিতা শনাক্তিতে আমি কতোটা ব্যর্থ হয়েছি।’
—হুমায়ুন আজাদ
তিনি যে রাগী এক লেখকের ইমেজ গড়ে তুলেছেন, সেখানে কিন্তু তাঁর কবিতায় তিনি ছিলেন খুব নরম, মৃদু এবং কিছুটা দুঃখীও বটে। ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ বা ‘গরিবের সৌন্দর্য’র মতো কবিতা তিনি খুব কম লিখেছেন। ‘আমাদের মা’ বা ‘আমার ছাত্র ও তার প্রেমিকার জন্য এলেজি’র মতো কবিতাই তিনি লিখেছেন প্রধানত। আর শিশুসাহিত্যে যে অসামান্য কাজ হুমায়ুন আজাদ করেছেন, সেটি বাংলাদেশের সাহিত্যে বিরল বলা চলে। তাঁর অসম্ভব দরদ দিয়ে লেখা বাচ্চাদের উপযোগী বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসবিষয়ক দুটি বই (এখন বিসিএস পরিক্ষার্থীরাও সেগুলোর ভোক্তা)। ভাষা নিয়ে দুই খণ্ডের বই, ভাষাবিষয়ক অ্যাকাডেমিক লেখাপত্র—অভিসন্দর্ভ, সংখ্যাতীত পরিশ্রমী প্রবন্ধগুলো অসামান্য ভাষায় লিখিত। এগুলো বহুদিন আমাদের কাজে আসবে এবং তাঁর কাছে নিয়ে যাবে আমাদের। উপন্যাস নিয়ে তাঁর অনুরাগীরাও আজকাল খুব কিছু বলেন না, বিভিন্ন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত হেতু বলতে সাহস পান না বলে মনে হয়। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি এ কথা বলতে পারি যে ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আজাদের ‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল’ উপন্যাসে চুল কাটাবিষয়ক কথাগুলো ২০০৭ সালেও সত্য ছিল। বাবরি চুল মাথায় নিয়ে আমি সেটা পড়েছি। এ ছাড়া ২০০৭ সালের দিকেই পড়া ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’–এর অপুরুষকরণ আমাকে ঘুমাতে দেয়নি!
সময় অনেক গড়িয়েছে। উল্টে গেছে পাশা, হাইব্রিড রেজিমে আমরা। কিন্তু আমাদের শেকল আরও শক্ত হয়েছে। এখন লেখার স্বাধীনতা কমে এসেছে আরও। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন ২০০৪ সালে। লেখার দায়ে তাঁর খুন ঝরেছে। এরপর...এরপর...ব্লগার...খুন খুন খুন...ভয়...বা ৫৭ ধারা...।
নিন্দাবাদের ভয়ে ভীত ছিলেন না হুমায়ুন আজাদ। কে কী বলবে, এটা ছিল তাঁর দূর বিবেচনা। যা তিনি ভাবতেন, তা–ই বলতেন। মোটকথা, বলতে পারার স্বাধীনতার তাঁর কাছে ছিল এক অমোঘ বস্তু। যার সন্ধানে তিনি বারবার রোদন করেছেন। এখন সময় ঘুরে গেছে। দিন এমন হচ্ছে, হুমায়ুন আজাদের নাম নেওয়াও যেন কিঞ্চিৎ বিপদের। ওত পেতে থাকা ছদ্মলেখকদের কেউ কেউ সেই সব খুনঝরানো লোকেদের পক্ষে আরও খুন ঝরাতে চান। রাষ্ট্রযন্ত্রের কথা বাদই দেওয়া যাক (ভয়ে)। কিন্তু এর বাইরেও আপনি নিরাপদ নন।
তবে একজন হুমায়ুন আজাদ, তিনি কিছুই তোয়াক্কা না করেই কথা বলে গেছেন। আজকের বাস্তবতায় লেখকদের অনেকেই যা পারেন না। হ্যাঁ, এখন আমরা প্রায় সবাই–ই শোচনীয়ভাবে এক সেন্সর-সেলফ সেন্সরের গহ্বরে ঢুকে গেছি। পক্ষান্তরে হুমায়ুন আজাদ সেই জাল ভেদ করতেই সারা জীবন ব্যয় করেছেন। যেমন তিনি বুঝেছেন, সেই পদ্ধতিতে। তাঁর সব সবলতা ও দুর্বলতা নিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন, অনুপ্রাণিত করবেন আমাদের। জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।