১৯৬৭ সালে পাকিস্তানে চাঁদ দেখা গেছে। সে জন্য বাংলাদেশে মানে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানেও ঈদ করতে হবে। অনেক সিপাহী কর্মচারীরা যদিও তারা তাদের রোজা ভাঙতে চায়নি। কয়েদীরা ঈদের নামাজও পড়তে চায়নি, সারা দেশের লোক ১৩ জানুয়ারি ঈদ পালন করলেও জেলের ভিতর সকলের ১২ তারিখেই ঈদ পালন করা লাগবে। ইচ্ছা না থাকলেও জেলার সাহেবের অনুরোধে ও সকলের সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে বঙ্গবন্ধু ঈদের নামাজ পড়তে গেলেন। একই জেলে থাকলেও অনেকদিন অনেকের সাথে দেখা হওয়ারও একটা চান্স তখন এই ঈদের নামাজ ছাড়া জেলে নাই বললেই চলে।
বঙ্গবন্ধুর আপন ভাগ্নে ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মণিও একই জেলে থাকলেও তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে পারতেন না, আদমজীর সফিসহ ১৯৬৬, ৭ জুন যেসব শ্রমিকদের ধরে আনা হয়েছিল তাঁদের অনেকেই তখন জেলে। বঙ্গবন্ধু সে সময় খুবই অসুস্থ ছিলেন। চোখের অসুখে ভুগছিলেন, পায়ে ফোঁড়া হয়েছিল এসকল অসুস্থতা নিয়েই তিনি সেসময় জেলের মধ্যে মামলার হাজিরা দিতে যেতেন। ঈদের আগে ১১ জানুয়ারি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যান জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বঙ্গবন্ধু বেশি কথা বলতে পারলেন না।
এবার ঈদে ছেলে-মেয়েরা এমন কি ছোট্র রাসেলসহ কেউ তাঁরা ঈদ পালন করবে না এমনই ঘোষণা দিয়েছে। ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে বঙ্গবন্ধু শুধু চিন্তা না করতে বললেন, আরো বললেন, "বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভালো করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে।"
বঙ্গবন্ধু লিখছেন, "চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ আমাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে, আরো কতো কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোন আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে।"
দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোক ১৩ জানুয়ারি ঈদ পালন করলেও জেলের ভিতর ১২ জানুয়ারিই ঈদ পালন হলো, কেননা পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি লোক চাঁদ দেখায় ঈদ উদযাপনের হুকুম এসেছে। বঙ্গবন্ধু ঈদের নামাজ পড়তে গেলেন এবং নামাজের আগে ও পরে শেখ ফজলুল হক মণি, শামসুল হক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল, মহিউদ্দীন খোকা, মহানগর আওয়ামীলীগ নেতা সিরাজ, হারুন, সুলতানসহ অনেকের সাথে কথা বললেন। বঙ্গবন্ধুর পায়ে ব্যথা ছিল সেজন্য বসে বসেই তিনি সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন এবং ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন, সবাইকে তিনি বললেন "পূর্ব বাংলার লোক সেদিনই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে পারবে, যেদিন তারা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে এবং দেশের সত্যিকারের নাগরিক হতে পারবে।"
নামাজ শেষ করে বাবু চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়।
১৯৬৭ সালের এই ঈদের নামাজের এই সম্মিলনে সেদিন কি হতে চলেছে কেউ তেমন একটা অনুমান করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু সেদিন শুধু অনুমানই করেন নি, তিনি এও জানতেন সামনে শুধু মহৎ কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে, যা হবে বাঙালির নতুন করে বেঁচে উঠার গোড়াপত্তন।
লেখক: কবি ও গবেষক।