প্রতি পাঁচ বছর পরপর শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করার কথা থাকলেও দু-একটি খাত বাদে কোনোটাই পুণঃপ্রণয়ন করা হয় না। তবে এবার ১৩টি খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি নিয়ে চলছে গড়িমসি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে খাতগুলোর মালিকপক্ষকে চিঠি দেওয়া হলেও এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি।
বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পরপর নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে হয়। এর ফলে সম্প্রতি সময়ে পরিবর্তনকৃত বৃহৎ ১৩টি খাতের শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খাতগুলোর মালিকপক্ষ এখনো কোনো সাড়া দেয়নি। বেসরকারি খাতগুলো হলো- বাংলাদেশ স্থল বন্দর, হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, হোসিয়ারি, সোপ অ্যান্ড কসমেটিকস, ফার্মাসিউটিক্যাল, টি প্যাকেটিং, জাহাজ ভাঙা, ট্যানারি, দর্জি কারখানা, কটন টেক্সটাইল, বেকারি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল।
ন্যূনতম মজুরি বোর্ডর সচিব রাইসা আফরোজ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘আমরা সব খাতগুলোর মালিক ও শ্রমিকদের মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছি। অনেকগুলো প্রস্তাব কিন্তু মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। নিয়মিত ফিল্ড ভিজিট হচ্ছে। মে মাসেই কয়েকটা খাতের মজুরি পুনর্নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আশা করছি সব খাতের শ্রমিকরাই উপযুক্ত বেতন পাবে।’
তৈরি পোশাক শিল্পে বর্তমানের ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করেন। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালের শুরুর দিকে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয় এবং ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে শ্রমিকদের ন্যূনতম ৮ হাজার নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয়।
অবশ্য দেশে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকহারে বাড়তে থাকায় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের দাবি উঠতে থাকে। এ দাবিতে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাজধানীর মিরপুর এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় শ্রম অসন্তোষও দেখা দেয়।
বর্তমানে মাসিক ৮ হাজার ৩৭৫ টাকা বেতন দেওয়া হয় তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত কর্মচারীদের। কিন্তু নতুন মজুইর বোর্ডে কি পরিমাণ বেতন নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি মালিক পক্ষ।
বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, "আমরা ইতিমধ্যে শ্রমিক প্রতিনিধির নাম পাঠিয়েছি। নতুন মজুরি বোর্ডে আমাদের চাহিদা অনুসারে বেতন পাব সেই আশা করছি।’’
জানুয়ারিতে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নামে শ্রমিকদের সাতটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্ল্যাটফর্ম নতুন মজুরি বোর্ড গঠন ও শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি ২২ হাজার করার দাবি জানায়।
১৯৮৩ সালের মোটর গাড়ি অধ্যাদেশ, দ্য মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৯২ সালের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন আইনে (নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ) নৌপরিবহন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের চাকুরির শর্তের বিধান রয়েছে। একই সালের টাইপ ফাউন্ড্রি খাতে বেতন ৫২১ টাকা, যা সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৩ সালে। প্রায় ৩৮ বছরেও সংশোধন হয়নি তাদের মজুরি খাত। এদিকে পেট্রল পাম্পের শ্রমিকদের বেতনও সরকারি হিসেবে ৭৯২ টাকা। এই মাসিক বেতন নির্ধারিত হয় ১৯৮৭ সালে।
দারিদ্র্যসীমার ওপরের স্তরে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে ‘জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ অনুযায়ী খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা কেনার ব্যয় মাসে ৯ হাজার ২৮০ টাকা। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীকে এ ক্ষেত্রে আয় করতে হবে ৬ হাজার ৪৪৫ টাকা।
সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে কাঙ্খিত পুষ্টিহার অনুযায়ী খাবার গ্রহণ ও জীবনধারণের জন্য একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। প্রকৃত খরচ অনুযায়ী বিবাহিত একজন শ্রমিকের মাসে আয় করতে হবে ১০ হাজার ৩৫২ টাকা।
বর্তমানে শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশের বেতনই ১০ হাজারের কম। দেশের মোট শ্রমিকের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কোনো সংগঠন বা সংস্থার কাছে নেই। তবে দেশে গার্মেন্টস খাতে মোট শ্রমিকের পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ। এ ছাড়া অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ খাতে ২০ লাখ, দর্জি শিল্পে ১০ লাখ, নির্মাণ খাতে ৩৫ লাখ ও ট্যানারি খাতে ২৫ হাজার শ্রমিক রয়েছে।