বিএনপির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব রহস্যময় জীবনের অধিকারী হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়েও রহস্যের শেষ হচ্ছে না।
গত ১১ জানুয়ারি থেকেই হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর প্রচার করে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম। কোনো কোনো গণমাধ্যম বলছে, হারিছ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে সাড়ে তিন মাস আগে মারা গেছেন। সেখানেই তার দাফন হয়েছে। আবার হারিছ চৌধুরীর মেয়ে বলছেন, “সাড়ে তিন মাস আগে তিনি রাজধানীতে মারা গেছেন এবং ঢাকায় তার দাফন হয়েছে।হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো কিছু জানানো হয়নি।
এমতাবস্থায় তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচারকে ঘিরে বিভ্রান্ত তৈরি হয়েছে। যদি তিনি মারাই যান তাহলে তিন মাস পর কেন হঠাৎ তার মৃত্যুর খবর প্রচার হলো? আসলেই হারিছ চৌধুরীর খবরটা কী? এ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রহস্য।
এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক বলেছেন, “হারিছ চৌধুরী লন্ডনে মারা যাননি, বরং ঢাকাতেই তার মৃত্যু এবং দাফন হয়েছে। এর ফলে হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরীর ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর শুরু হওয়া আলোচনার সমাধান হচ্ছে না।
গত ১১ জানুয়ারি রাতে আশিক চৌধুরী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে হারিছ চৌধুরী ও তার ছবি সংযুক্ত করে তিনি লেখেন, ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন’। এরপর ওই স্ট্যাটাসের নিচে বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরাসহ অনেকে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ ও শোক প্রকাশ করে মন্তব্য করেন। এসব মন্তব্যের পরপরই হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
মঙ্গলবার রাত ১২টায় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘সাড়ে তিন মাস আগে লন্ডনে মারা গেছেন হারিছ চৌধুরী’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রচার করে। এর পরের দিন দুপুরে দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে ‘হারিছ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন, জানালেন চাচাতো ভাই’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রচার হয়। ওই দুই গণমাধ্যমে চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরীকে উদ্ধৃত করা হয়।
তবে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে সবশেষ নুতন রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। একটি গণমাধ্যমকে হারিস চৌধুরীর মেয়ে সামীরা তানজীন চৌধুরী মুন্নু জানান, তার বাবা ঢাকাতেই মারা গেছেন। সিলেটের কানাইঘাটে পারিবারিক গোরস্থানে দাদুর কবরের পাশে বাবাকে সামাহিত করা হয়েছে বলে জানান সামীরা। তিনি আরও জানান, “আশিক চাচা (আশিক চৌধুরী) সাহস করলেন না।”
হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপনে থাকাকালে পরিবারের সঙ্গে খুব সামান্যই যোগাযোগ হয়েছে উল্লেখ করে সামীরা বলেন, “বাবা চাইতেন, যা হয় তার ওপর দিয়ে যাক। সন্তান হিসেবে আমাদের, আত্মীয়স্বজন, এমনকি তিনি যে রাজনীতি করতেন সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বও যাতে তার কারণে কোনো বিপদে না পড়ে সে জন্য কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না। মাঝেমধ্যে তিনি ফোনে সবার খোঁজ নিতেন।”
সামীরা আরও বলেন, 'আমি কয়েক ঘণ্টার নোটিশে সব ছেড়েছুড়ে গত ২৭ আগস্ট ঢাকা পৌঁছাই। ততক্ষণে বাবা লাইফ সাপোর্টে। করোনা থেকে নিউমোনিয়া হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাঁচাতে পারলাম না বাবাকে। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক মুহূর্ত আড়াল করতে চাইনি। সবসময় তার পাশে বসেছিলাম। ভয় আর শঙ্কা আমাদের সব তছনছ করে দিল “
হারিছ চৌধুরীর মেয়ে আরও বলেন, “ মাত্র কয়েক দিন আগে ছোট চাচা (সেলিম চৌধুরী) স্ট্রোক করে মারা গেলেন। তার আগে মারা গেলেন হাসনাত চাচা (হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই), হারালাম এক ফুপু ও চার ফুপাকে। এমন বিপর্যয় আর কোনো পরিবারে হয়েছে কি না আমার জানা নেই।”
এর আগে, যুক্তরাজ্য বিএনপি সভাপতি এম এ মালিক বলেন, “হারিছ চৌধুরী তিন মাস আগে মারা গেছেন বাংলাদেশে। আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলছি হারিছ চৌধুরী ১/১১-এর পর কখনই বাংলাদেশ ছাড়েননি। তিনি এমনকি ভারতেও যাননি। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন।”
এম এ মালিক দাবি করেন, “হারিছ চৌধুরী ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে ঢাকাতেই ছিলেন। লন্ডনের বিষয়টা টোটালি ভিত্তিহীন। কারণ তার সঙ্গে আমার পারিবরিক, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তার ছেলে-মেয়ে, ভাবি সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি ঢাকাতেই মারা গেছেন এবং ঢাকায় দাফন করা হয়েছে। এটা সত্য ঘটনা, আমি খুব ঘনিষ্ঠ সূত্রে বিষয়টা জানি এবং তাকে ঢাকায় দাফন করা হয়েছে। এ বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারেন, তিনি লন্ডনে আসেননি। তার বড় বোনের ঢাকার বাড়িতে থাকতেন। মাঝেমধ্যে অন্য ভাইদের বাসায়ও থাকতেন। এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, তিনি বাংলাদেশের বাইরে কোথাও আসেননি, কখনো আসেননি।”
তবে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কায়সর আহমেদ বলছেন অন্য কথা। হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে কোনো তথ্যই জানেন না বলে দাবি করেছেন তিনি। যুক্তরাজ্য বিএনপি সাধারণ সম্পাদক বলেন, “তিনি কখনো যুক্তরাজ্যে ছিলেন কি না বা এসেছিলেন কি না কিছুই আমাদের জানা নেই। মৃত্যুর সংবাদ পত্রিকা মারফত জেনেছি।”
এদিকে, বিএনপি স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেও হারিছ চৌধুরীর বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, হারিছ চৌধুরী দলেও নেই, কোথাও নেই। কোথায় পালিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তার খোঁজ রাখার প্রয়োজন নেই। “
২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর হারিছ চৌধুরী সস্ত্রীক তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগরে যান। কয়েক ঘণ্টা পর যৌথ বাহিনী হারিছের বাড়িতে হানা দেয়। তবে হানা দেওয়ার আগেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সরে পড়েন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তথ্যমতে সিলেটে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারত চলে যান। ভারতের আসামে করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরে তার নানাবাড়ি। সেখানেই তিনি ওঠেন। এরপর শোনা যায় হারিছ চৌধুরী ইরানে ছিলেন। আরও শোনা যায় হারিছ চৌধুরী স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে যুক্তরাজ্যে থাকতেন।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন সাজা হয় হারিছ চৌধুরীর। একই বছর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হারিছ চৌধুরীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশপাশি তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। বর্তমানে সেই মামলা বিচারাধীন।