আগস্ট ১১, ২০২৫, ০৫:৫৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
মাদকের সংঘাতে ফের অস্থির হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুরে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের আবাসস্থল জেনেভা ক্যাম্প।
সোমবার, ১১ আগস্ট দুপুরের পর ৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় লাঠি ও দেশি অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছে দুই পক্ষ। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শাহ আলম (২০) নামের এক তরুণ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারী পুলিশ কমিশনার (মোহাম্মদপুর জোন) মেহেদী হাসান।
তিনি জানান, এ ঘটনায় ফয়সাল নামে একজনকে চাপাতিসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে সেলিম নামের আরেকজনকে ধরা হয়েছে।
ক্যাম্পের বাসিন্দা এক স্কুল শিক্ষক বলেন, সোমবার ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে দুই পক্ষ। কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণের শব্দও শোনা গেছে।
এর আগে রোববার রাতে ককটেল বিস্ফোরণে এক নারী আহত হন জানিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশ ও সেনাবাহিনী এলে সব ঠান্ডা থাকে। তারা চলে যাওয়ার পর আবারও সংঘাতে জড়ায় মাদক কারবারিরা।”
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার ইবনে মিজান বলছেন, মাদক কারবারি পিচ্চি রাজা ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপের দ্বন্দ্বে এ সংঘাত চলছে।
তিনি সোমবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বলেন, “মাদক ব্যবসা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ তাদের মধ্যে। তারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সম্প্রতি জামিনে বের হয়ে এসে মাদক ব্যবসার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আবারও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন।
“আমরা নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছি। এখন পরিবেশ শান্ত আছে।” খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
রাজনৈতিক অস্থিরতার বছর ২০২৪ সালে মাদক কারবারের দখল নিয়ে কয়েক দফা সংঘাত ও কয়েকজনের প্রাণহানির পর সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখন যেসব মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তারা জামিনে বেরিয়ে পুরনো ব্যবসার দখল নিতে ফের সংঘাতে জড়াচ্ছে বলে ভাষ্য পুলিশের।
পুরনো দ্বন্দ্বই নতুন করে
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বছর কয়েক আগে পুরো ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল নাদিম হোসেন ওরফে পাঁচ্চিশ ও ইশতিয়াক নামের দুই যুবকের হাতে। দুজনই মাদক কারবার করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন, পালতেন ব্যক্তিগত বাহিনী।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে পূর্বাচলে র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন পাঁচ্চিশ। এরপর ভারতে পালিয়ে যান ইশতিয়াক। মহামারীর সময় কোভিড আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান বলে ক্যাম্পে জনশ্রুতি আছে।
পাঁচ্চিশ ও ইশতিয়াকের অবর্তমানে ক্যাম্পের শতকোটি টাকার মাদক কারবারের দখল নিতে উঠেপড়ে লাগে দুটি পক্ষ। একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন বুনিয়া সোহেল, আরেকটি পক্ষের নেতা চুয়া সেলিম। আর বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে যুক্ত হন সৈয়দপুইরা (নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে আসা ‘বিহারি’) নামের আরেকটি পক্ষের নেতা বাবু ওরফে সৈয়দপুইরা বাবু।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংঘাতের কারণে প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছিল জেনেভা ক্যাম্প। এর মধ্যে গত বছরের ৩১ অক্টোবর সিলেটের কোতোয়ালী ও হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকা থেকে বুনিয়া সোহেলসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তার দুই মাস বাদে চুয়া সেলিমও গ্রেপ্তার হন। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর পিচ্চি রাজাসহ ৩১ জনকে গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছিল র্যাব।
সম্প্রতি বুনিয়া সোহেল ও পিচ্চি রাজা (বর্তমানে চুয়া সেলিম সমর্থক) জামিনে বেরিয়ে এসে নতুন করে দখলদারিত্বে নামলে এ সংঘাত ধীরে ধীরে তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, এই ক্যাম্পের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ক্যাম্পের প্রধান তিনটি গ্রুপের মধ্যে বুনিয়া সোহেল ও তার লোকজনেরা বেশিরভাগই থাকেন ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরে, এই এলাকায় মাদক বেচাকেনা করে বুনিয়া সোহেলের লোকজন। সৈয়দপুইরা বাবু গ্রুপের এলাকা হচ্ছে এনএলজে স্কুল রোড, সেখানেই তাদের মাদক বেচাকেনার কেন্দ্র বা স্পট। আর চুয়া সেলিমের এলাকা হচ্ছে এবি ব্লক পাক্কা (পাকা) ক্যাম্প।
সম্প্রতি ৭ নম্বর সেক্টরের হুমায়ুন রোড এলাকায় নতুন করে মাদক বিক্রি করা শুরু করেছে পিচ্চি রাজা ও ইমতিয়াজ। পিচ্চি রাজা একসময় বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে কাজ করলেও এখন তিনি চুয়া সেলিমের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বলে ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানিয়েছেন। আর ইমতিয়াজ ক্যাম্প এলাকায় চুয়া সেলিমের পুরনো বন্ধু হিসেবে পরিচিত।
অন্যদিকে ৭ নম্বর সেক্টর এলাকাটি বুনিয়া সোহেলের পুরনো এলাকা। কয়েকদিন ধরে ওই এলাকার মাদক ব্যবসার দখল নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘাত ও অস্থিরতা চলছে।
বৃহস্পতিবার রাতে চুয়া সেলিমের আস্তানা পাক্কা ক্যাম্প এলাকায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের সামনে পরপর তিনটি ককটেল বিস্ফোরণে দুজন আহত হন। স্থানীয়দের ভাষ্য, বুনিয়া সোহেল নিজে মোটর সাইকেলে করে এসে ককটেল ফাটিয়ে চলে যান।
সেদিন থেকেই ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় কয়েক দফায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। রোববার দুপুরেও ককটেলের আওয়াজ পেয়েছেন ক্যাম্পবাসী। সোমবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফায় ককটেল ফুটেছে বিভিন্ন জায়গায়।