ডিসেম্বর ২, ২০২৪, ০৫:৩৯ পিএম
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর: প্রত্যাশা ও অগ্রগতি শীর্ষক’ এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপরিকল্পনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্তর্ভুক্তি জরুরি।
রবিবার, ২ ডিসেম্বর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম-সমন্বয়কারী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন দৈনিক সমকালের সম্পাদক আবু সাঈদ খান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, নাগরিক ঐক্যর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গণতন্ত্র মঞ্চের সৈয়দ আব্দুল মাহবুব, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম-সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথেন প্রমীলা, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য অনিক রায় প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম-সমন্বয়কারী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য দীপায়ন খীসা।
দৈনিক সমকালের সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, ২৭ বছর আগে যখন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হয় তখন সমগ্র দেশে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চুক্তির এত বছর পরেও সেখানকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে চুক্তি পূর্ব সময়ের মত করেই পার্বত্য এলাকাকে শাসন করা হচ্ছে। জোর জবরদস্তি করে যেন সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছে। কিন্তু সামরিক কায়দা কোন সমাধান নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। সমাধান হবে রাজনৈতিকভাবে, সমাধান হবে মানবিকভাবে। ২৭ বছর যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা চুক্তিকে উপেক্ষা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারী এবং বেসরকারীভাবে ব্যাপক আগ্রাসন চলছে। সেখানে ভূমিদখল চলছে। সেখানে ইকোপার্ক, পর্যটন কেন্দ্রের নামে এখনো ভূমিদস্যুভিত্তিক এলাকা রয়েছে। এগুলো বন্ধ করা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরত আসবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে রেখে দেশে শান্তি আসবে না। বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, মানবিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।
জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ। এ আন্দোলনে দেশের আপামর জনসাধারণ অংশগ্রহণ করেছে। অংশগ্রহণ করেছে দেশের আদিবাসী বাঙালীসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ। এটা ছিলো ইনক্লুসিভ সোসাইটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমরা যে দৃশ্য মিছিলে দেখেছি সে দৃশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কেবল বাঙালীর রাষ্ট্র নয়, গারো, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মনিপুরি খাসিয়া সকলের রাষ্ট্র। বাংলাদেশ কেবল মুসলমানের দেশ নয়, এদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সকলের দেশ। এদেশে যদি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন যদি তৎপরতা চালাতে পারে তাহলে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনও তৎপরতা চালাতে পারবে। মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন যদি নিষিদ্ধ না হয় তাহলে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনও নিষিদ্ধ হওয়ার যুক্তি নেই। আমি জানিনা কোন বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ে মৌলবাদী সংগঠন রয়েছে কিনা। যদি থাকে তাও তারা তৎপরতা চালাতে পারে। তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু যেটা জরুরী সেটা হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ পথেই সকলের অবস্থান হওয়া উচিত। সবার জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে আমরা বাঙালী-আদিবাসী সকলেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি যেখানে সব মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সেই উদারতা বাঙালী জনগোষ্ঠীদের দেখাতে হবে কেননা তারা সংখ্যাগুরু। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদের জন্য অবস্থান তৈরী করতে হবে, ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। সেটা রাষ্ট্রের সিস্টেমের মধ্যেও প্রতিফলন দেখাতে হবে। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যূত্থানের চেতনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। যারা চুক্তি বাস্তবায়নের পথকে বাধাগ্রস্থ করতে চায় তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের পথকে মসৃণ করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম-সমন্বয়কারী জাকির হোসেন নিবন্ধ পাঠ করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশ একটি বহুজাতি, বহুভাষা এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির দেশ। বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এখানে ৫৪টিরও বেশি আদিবাসী জাতি সুপ্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম এবং সমাজব্যবস্থা নিয়ে বসবাস করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ১১টি জুম্ম আদিবাসী সম্প্রদায়সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি দেশের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বৈচিত্র্যের অন্যতম প্রমাণ। তবে বিশ্বায়ন এবং তথাকথিত আকাশ-সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের নিজস্ব জীবনধারা ও সংস্কৃতি ক্রমশ বিলুপ্তির পথে।
পরিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়ন কার্যক্রম পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলছে। বাণিজ্যিক বৃক্ষায়ন, যেমন সেগুন বা রাবার বাগান, পাহাড়ের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানকে ব্যাহত করছে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম পাহাড়িদের জুম চাষের মতো প্রকৃতিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাকে সংকটে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী উন্নয়ন দর্শন আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রথাগত জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। উন্নয়নের নামে গৃহীত প্রকল্পগুলোতে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ নেই, যা তাদের আরও প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন কার্যক্রমের আড়ালে সামরিকীকরণ ও শোষণের রাজনীতি বিদ্যমান। বিদেশি সহায়তা মূলত সামরিক অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে, যা শান্তি-সম্প্রীতির নামে আদিবাসীদের মনস্তাত্ত্বিক দমন ও শাসনের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং পর্যটনশিল্পের প্রসার আদিবাসী সংস্কৃতিকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে। তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের পরিবর্তে এটিকে বাণিজ্যিকীকরণ এবং প্রদর্শনের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিজস্ব পরিচয়কে ক্ষুণ্ন করছে।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। তবে এর বাস্তবায়ন এখনও অপর্যাপ্ত। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি সম্পূর্ণ কার্যকর হয়েছে। ভূমি অধিকার, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষমতায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম কমানোর কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যকার অবিশ্বাস দূরীকরণ এবং উন্নয়নের সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন শুধুমাত্র এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য নয়, দেশের আদিবাসী জনগণের অধিকার এবং জাতিগত ঐক্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট সময়সীমা এবং কার্যকরী কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। সামরিক তত্ত্বাবধান বন্ধ করা, আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদকে ক্ষমতায়ন করা, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে সক্রিয় করা, এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা করার মতো পদক্ষেপ জরুরি। এছাড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। চুক্তি বাস্তবায়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কার্যক্রমকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগানোই পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল চাবিকাঠি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য অনিক রায় বলেন, যখন চুক্তি হয় তখন আমার বয়স ছিলো ৪ বছর। কিন্তু আজ অবধি চুক্তির বাস্তবায়ন করা হয় নি। জুলাই আন্দোলনে আদিবাসী-বাঙালী সকলে মিলেই ফ্যসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলো। তিনি বলেন, রাষ্ট্র সর্বদা বিভক্তি করে রাখতে চায়। কিন্তু জুলাই অভুত্থানের পর রাষ্ট্র নতুন সেটলম্যন্টের দিকে আগানোর সময় এ বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ৫৩ বছর পরেও আমরা একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যেখানে ব্রিটিশ আমলে আদিবাসী বলা হয়েছে, পাকিস্তান আমলে আদিবাসী বলা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে পারছি না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপরিকল্পনায় আদিবাসীদের দাবীগুলো অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে অগ্রাধিকার তালিকায় উপড়ের দিকে রাখার জন্যও তিনি এ সরকারকে আহ্বান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়াই করতে গিয়ে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিলো সমাজের মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু তা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এবারের জুলাইয়ের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যও ছিলো বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ করা। কিন্তু এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। তাহলে এ স্বপ্নগুলো শুধু মুখের কথার মধ্যে কেন সীমাবদ্ধ থাকবে। ২৭ বছর আগে হওয়া পার্বত্য চুক্তিও শুধুমাত্র বাস্তবায়ন চায় বললেই কাজ শেষ হয়ে যায় না। বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার হয়। কিন্তু অন্তর্বতীকালীন সরকারের এ ৩ মাসের কর্মকান্ডে কি আমরা পার্বত্য চট্টগাম চুক্তি বাস্তবায়নের আলামত দেখতে পাচ্ছি? চুক্তি মোতাবেক সেনাক্যাম্প উত্তরণ দেখছি? মোটেই না।
তিনি বলেন, প্রথম সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় হচ্ছে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছি। শুধুমাত্র কাগজে লিখলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কোন সিদ্ধান্তের সাথে ঐক্যমত্য আসলে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।
আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপরিকল্পনায় সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নকে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে যেন রাজনৈতিক সরকার এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয় নচেৎ সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথেইন প্রমীলা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বহুত্ত্ববাদের স্বপ্ন দেখেছিলেন কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্র একত্ববাদী রাষ্ট্রের দিকে এগুচ্ছে। তিনি বলেন, আমি আশা করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সবসময় নিরাপত্তার চোখে না দেখে সেখানকার অধিবাসীদের মানবিক মর্যাদায় বেঁচে থাকার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতি দিলেই পার্বত্য এলাকায় শান্তি ফিরে আসবে।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আজকে একটি ঐতিহাসিক দিন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই চুক্তিকে স্বীকার করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই চুক্তি যেন বাস্তবায়ন না হয় সেজন্য বিভিন্ন বিরোধী পক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছে। পাহাড়ীদেরকে সেখানে সংখ্যালঘু করে দেওয়ারে উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে সেটলার বাঙালী নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদেরকে দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় একটি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে অথচ সেখানকার আদি বাঙালীদের সাথে পাহাড়ীদের কোন ধরণের সমস্যা নেই।
তিনি বলেন, ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি করা চুক্তির একটি অন্যতম দিক। এ লক্ষ্যে ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ২২ হাজারের অধিক আবেদন পত্রও জমা পড়েছে। কিন্তু সেই কমিশন এখনো অকার্যকর অবস্থায় রয়ে গেছে। কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ আজ খালি রয়েছে। অবিলম্বে কমিশনে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আরও বলেন, চুক্তির আরো একটি বড় বাধা হলো সেখানকার সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন। একদিকে সেনাশাসন জারি রেখে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়ন না করার ফলে প্রশাসনিক সমস্যাগুলোরও সমাধান হচ্ছে না।
তিনি বলেন, অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের সমতল অঞ্চল থেকে বাঙালী সেটলারদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে পার্বত্য এলাকায় সেটল করা হয়েছে । তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনয়নের জন্য, বন ও পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য, পাহাড়কে বাঁচানোর জন্য তাদেরকে দেশের সমতল অঞ্চলে সম্মানজনক পুনর্বাসন করতে হবে। বিভিন্ন দাতাসংস্থা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্য সর্বদা তৈরি রয়েছেন।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা। এটাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের আমরা আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে পারিনি। এটা আমাদের সকলের ব্যর্থতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কমিশনগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্য আসতে হবে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন কাজ পরিচালনা করার জন্য আঞ্চলিক পরিষদ নিজ উদ্যোগে বিধিমালা প্রণয়ন করে ১৫ বছর আগে ভূমি কমিশনে জমা দিয়েছে। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক অসদিচ্ছার কারণে সেটি এখনো প্রণয়ন করেনি। সেখানে সেটলারদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ভূমির সমস্যাটি এখনো জিইয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে নিরাপত্তার অজুহাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন জারি রাখা হয়েছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর সেখানকার মানুষদের আজ নিরাপত্তার সমস্যা নেই। বরং সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে সেখানকার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরী করে দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে জন্য একটি আদিবাসী কমিশন গঠন করা যেতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
নাগরিক ঐক্যের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গণতন্ত্র মঞ্চের সৈয়দ আব্দুল মাহবুব বলেন, বাংলাদেশ বহু ভাষার, বহু বৈচিত্র্যের, বহু সংস্কৃতির একটি দেশ। এদেশে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষদের মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। কিন্তু যে দেশে সংবিধানের ৭০ ধারায় সংসদে সংসদ সদস্যদের কথা বলার স্বাধীনতা নেই, সেখানে সাধারণ মানুষদের কথা বলার স্বাধীনতা কেমনে থাকবে। তিনি বলেন, এ সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নাই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার পরিচয় যদি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না থাকে তাহলে সে সংবিধান থাকার দরকার কি।
তিনি আরো বলেন, যে পার্বত্য চট্টগ্রামেকে নিয়ে আমরা বিশ্বের বুকে গর্ব করে কথা বলি সে পাহাড়কে আমরা আজ ধ্বংস করছি। সেখানকার বনভূমি, প্রাণ বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে আমরা লোকদেখানো উন্নয়ন করছি। সেখানকার আদিবাসী পাহাড়ীদেরকে আরো প্রান্তিকতায় ঠেলে দিচ্ছি। এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে। তিনি যখন বহু জাতির, বহু সংস্কৃতির বাংলাদেশকে এক জাতির বাংলাদেশ বানাতে চেয়ে বলেছিলেন। তিনি যখন সকলকে বাঙালী হয়ে যেতে বলেছিলেন তখন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের নেতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা অত্যন্ত সহজ সরল। তারা শান্তি আনয়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছর পরেও চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া তাদেরকে হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, জনগণের আকাঙ্খাকে অবহেলা করার পদ্ধতি রাষ্ট্রযন্ত্রের সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে। যার কারণে পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর পরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষেরা শান্তিতে বসবাস করতে চেয়েছিল। সেজন্য তারা রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উপণীত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির এত বছর পরেও কি আদিবাসীরা কি প্রতি পদে পদে নিপীড়িত হবে? তিনি বলেন, দেশের এক ভাগকে পেছনে রেখে দেশ কখনো সামনে এগোতে পারবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রমাণ করুক তারা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন করতে চান। এ সরকার দেশের সকল পেশা শ্রেণীর মানুষের অধিকারকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে উচ্চতর স্থানে নিয়ে যাক।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো না। সরকার দাবী করলেও আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পার্বত্য চট্টগাম চুক্তির মৌলিক মৌলিক বিষয়গুলোর এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সেখানকার পাহাড় ধ্বংস হচ্ছে, বন ধ্বংস হচ্ছে। পার্বত্য এলাকার বনের সাথে সেখানকার আদিবাসীদের যুগ যুগব্যাপী এক পারস্পারিক সম্পর্ক রয়েছে। বনকে ধ্বংস করে বিনাশী উন্নয়ন আদিবাসী জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক চিন্তার কোন পরিবর্তন হয়নি। পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কে গোটা রাষ্ট্রের মানসপটের পরিবর্তন হওয়া জরুরী্।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে বিভক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির বিরোধীতা করে যে সমস্ত গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো এখনো তৎপর রয়েছে। এসকল গোষ্ঠীগুলোর সৃষ্টি হয়েছে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে।
আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট একটি রাজনৈতিক সংকট। এ সমস্যাকে সামরিক কায়দায় সমাধানের চেষ্টা করলে সমাধান আসবে না। রাজনৈতিক কায়দায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটকে মোকাবেলা করতে হবে। ডেমোগ্রাফির পরিবর্তন করেও এ সমস্যার সমাধান হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর্যালোচনা করতে হবে। কোন কোন বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি তার মূল্যায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরী। এ লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করা দরকার। নতুন রাষ্ট্র নির্মাণে পার্বত্যবাসীকে অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরী বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সভাপ্রধানের বক্তব্যে অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের এবং জুলাই আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা থেকেই তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত হয়ে সংসদে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা ব্রিটিশ-পাকিস্তান সময়ের রাজতন্ত্র ভেঙে গণতান্ত্রিক স্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদেরকে সবসময় দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। যার ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সূত্রপাট ঘটে। এ রাজনৈতিক সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর অনেক আশা-আকাঙ্খা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আরো বেশী প্রান্তিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন না করার কারণে দেশের আদিবাসীদের মানবিক অধিকারকেও ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে পারি না। এ অঞ্চলকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে কখনো পরিপূর্ণ মনে হয় না।