জুলাই ৯, ২০২৫, ০২:২৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ১৭টি স্থানে ভাঙ্গন ধরেছে। প্লাবিত হয়েছে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার অন্তত ৩০ গ্রাম। উপজেলা দুটিতে বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগও।
এদিকে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় মঙ্গলবার রাত থেকে ছোট-বড় সব ধরনের যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে পরশুরাম উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৯৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত জেলায় সর্বোচ্চ ৪৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যা ফেনীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ছিল। খবর বিডিনিউজ টয়েন্টিফোর ডটকম।
বৃহস্পতিবার-শুক্রবারও ফেনী ও আশপাশের এলাকায় মাঝারি থেকে অতিভারী বর্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে সীমান্তবর্তী মুহুরী নদীর পানি বুধবার বেলা ১২টায় বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ১৫ উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে মঙ্গলবার রাত ৯টায় নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩৭ সেন্টিমিটার উপরে ছিল।
দুদিনে তিনটি নদীর বাঁধের অন্তত ১৭টি অংশে ভেঙে নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে জানান এই প্রকোশলী।
পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বিদ্যুৎ বন্ধ, নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট
এদিকে টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট মোবাইল সংযোগ। এতে পানিবন্দী এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন স্বজনরা।
ফেনী থেকে পরশুরামগামী যাত্রী জাহানারা ফেরদৌস বলেন, বাড়িতে তার বৃদ্ধ মা একা অবস্থান করছে।
মায়ের চিন্তায় উদ্বিগ্ন এই নারী বলেন, “ঢাকা থেকে সকালে ফেনী এসে পৌছলেও পরশুরাম সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় মায়ের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়নি।”
এ উপজেলার পশ্চিম অলকা গ্রামের বাসিন্দা মাসুম চৌধুরী বলেন, “সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের আলতাফ আলী চৌধুরী বাড়ির (৮ নং ওয়ার্ড) পিছন অংশ ভেঙে সন্ধ্যা ৭টার পর তাদের ঘরের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে আতঙ্কে রাত কাটিয়েছেন।”
উত্তর মণিপুর গ্রামের বাসিন্দা আবু বক্কর ছিদ্দিক রুবেল বলেন, “আমাদের গ্রামের প্রায় ৬০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। যাদের দোতলা ঘর আছে, অনেকে সেসব ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।”
একই পরিস্থিতি ফেনীর ফুলগাজীর উপজেলাতেও।
ফুলগাজীর সদর ইউনিয়নের উত্তর শ্রীপুর পূর্বপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ নুরুল ইসলাম বলেন, তার ঘরে গলা পর্যন্ত পানি থাকায় তিনি স্ত্রীসহ পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। হঠাৎ পানি বাড়ায় দুটি গরু উদ্ধার করতে পারলেও হাঁস ও মুরগী পানিতে ভেসে গেছে।
একদিকে সন্তান নেই, অপরদিকে বাড়িতে পানিবন্দি হয়ে সব মালামাল নষ্ট হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এই দম্পতি।
একই এলাকার আলী রাজ বলেন, তার বাড়ি সংলগ্ন স্থানে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের অন্তত ৩০ মিটার ভেঙে তার ও তার ভাইয়ের বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পুরো ঘরটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় কোনো আসবাবপত্র বের করা সম্ভব হয়নি।
ফুলগাজী বাজারের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, বাঁধ ভেঙে নদীর পানি প্রবেশ করায় বাজারের শতাধিক দোকান পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব দোকানের সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে।
খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র, কন্ট্রোল রুম
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারিয়া ইসলাম বলেন, বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ফুলগাজী উপজেলার সাতটি অংশে ভেঙেছে। ভাঙ্গনকৃত স্থান দিয়ে পানি ঢুকে অন্তত ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দীদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন বলে জানান তিনি।
পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান বলেন, বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত পরশুরাম উপজেলার মুহুরী, কুহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ১০টি স্থানে ভাঙ্গন ধরেছে।
এর মধ্যে মুহুরি নদীর ছয়টি স্থানে, কহুয়া নদীর তিনটি স্থানে ও সিলোনিয়া নদীর একটি স্থান ভেঙেছে।
আরিফুর রহমান আরও বলেন, তার উপজেলার ১৫টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। অনেক পরিবারের সদস্যরা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন বলেন, “জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশ বন্যা কবলিত হয়েছে।
“বন্যা মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছেন। ত্রাণ ও দুর্যোগ শাখার সমন্বয়ে জেলা প্রশাসনের একাধিক দল বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ২৪ ঘণ্টা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, বুধবার দুপুর পর্যন্ত তিন উপজেলার প্রায় ১১ হাজার ৫০০ মানুষ দুর্যোগ কবলিত হয়েছেন। এর মধ্যে তিন উপজেলায় ১১৫টি পরিবারের ৩৪৭ জন মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, “বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক নজরদারি রাখা হচ্ছে। এর মধ্যেই বন্যা কবলিত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় চারশত প্যাকেট শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে।”
এছাড়া ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী, দাগনভূঞা ও ফেনী সদর উপজেলায় ত্রাণ কার্য পরিচালনার ১২০ টন চাল উপবরাদ্ধ দেয়া হয়েছে।
দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলার ছয় উপজেলায় ত্রাণ কার্য পরিচালনায় নগদ ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা উপবরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, “ভারী বর্ষণ বন্ধ থাকায় নদীতে পানি কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি বন্ধ হলে এবং নদীর পানি কমলে ভাঙন কবলিত স্থানগুলো মেরামতের কাজ শুরু করা হবে।”
নতুন করে যেন বেড়িবাঁধের আর কোনো স্থান না ভাঙে সেজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা তৎপর রয়েছেন বলে জানান তিনি।