জুলাই ১৬, ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
চলমান ছাত্র বিক্ষোভে প্রাণহানির বিষয়ে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনও আনুষ্ঠানিক তথ্য না থাকা সত্ত্বেও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে ভিন্ন কথা।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত গুজবের মাধ্যমে মার্কিন দপ্তরটি প্রভাবিত হতে পারে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুরু হয়েছে জল্পনা।
স্থানীয় সময় ১৫ জুলাই দুপুর সোয়া একটার দিকে অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও তাদের ওপর হামলার বিষয়ে জানতে চান। তিনি প্রশ্ন করেন, সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগের পক্ষে ও কোটা বাতিলের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসব বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীকে হুমকির পর পরই বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করেছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগ। এতে প্রায় অর্ধসহস্রাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এমনকি যেসব আহত শিক্ষার্থী জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিলেন, হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদের ওপরেও হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। বাংলাদেশে চলমান এই বিক্ষোভের ব্যাপক আকার ধারণ নিয়ে আপনাদের অবস্থান কি?
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জবাব দেন, “বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র জানে। হামলায় শত শত মানুষ আহত হয়েছেন এবং দুজন নিহতও হয়েছেন। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।”
তিনি আরও বলেন, “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ যেকোনও বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে যেকোনও ধরনের সহিংসতার নিন্দা করি আমরা।”
এ ছাড়া যারা এই সহিংসতার শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের প্রতি সমবেদনাও প্রকাশ করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হলে ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র লিওনার্ড হিল বলেন, বিবৃতিটি আহত ও নিহতের ‘মনিটরিং রিপোর্ট’র ভিত্তিতে ছিল।
তিনি আরও বলেন, “আমরা সবসময় সবচেয়ে সঠিক তথ্য খোঁজার চেষ্টা করি ও সত্য উদ্ঘাটনে সাংবাদিকদের কাজকে স্বাগত জানাই।”
মুশফিকুল ফজল আনসারী নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ভিত্তিক সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস নামের একটি মাসিক মতামতভিত্তিক ম্যাগাজিনের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেন।
মুশফিক ফজল আনসারী, ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর ভাগ্নে হিসেবে পরিচিত। আনসারী বিএনপির আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির সাবেক সদস্য সচিব ছিলেন বলে জানা গেছে।
চলতি সপ্তাহের রোববার চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে করা প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কিছুই পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা সব পাবে?”
গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি’ বলার অভিযোগ করে রোববার রাত থেকে প্রতিবাদ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাতে প্রথমে রোকেয়া হলের মেয়ে শিক্ষার্থীরা হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়ে আসেন। তারা স্লোগান দেওয়া শুরু করেন ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে ছেলেমেয়ে শিক্ষার্থীরা দলে দলে মিছিল নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ শেষে হলে ফিরে যান তারা।
একই সময় (রোববার মধ্যরাতে) চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
একই ইস্যুতে সোমবারও উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। দুপুরের দিকে ছাত্র-সম্মেলন কেন্দ্রের (টিএসসি) পাদদেশে রাজু ভাস্কর্যে এসে কয়েক শ’ আন্দোলনকারী অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার চেয়ে নানা শ্লোগান দেন। তবে তাদের ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ শ্লোগান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলাদা অনুষ্ঠানে তাদের স্লোগানের ভাষার তীব্র সমালোচনা করেন।
এরপর ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয় ছাত্রলীগ। দুপুর দুইটার দিকে তারা বিজয় একাত্তর হলসহ বিভিন্ন হলে আন্দোলনকারীদের বাধা দেন। এই খবরে আন্দোলনকারীরা ছুটে গেলে ছাত্রলীগের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। উভয়পক্ষ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর থেকে গোটা ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
বিকেল চারটার পর থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা শুরু করে ছাত্রলীগ। বহু আন্দোলনকারীকে পিটিয়ে আহত করে তারা। তাদের অনেকের মাথা ফেটে যায়। আন্দোলনকারীরা কোথাও কোথাও প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ফলে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়।
বিকেল চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের বেশির ভাগই ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া আশপাশের অন্যান্য হাসপাতালেও গেছেন কেউ কেউ।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও (চবি) বিকেল থেকে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। অনেকেই সেখানে আহত হন। এ ছাড়া সোমবার বিকেলে আন্দোলনে নামেন রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন।