টিকার খরচে ২৩ হাজার কোটি টাকার ফারাক পেয়েছে টিআইবি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১২, ২০২২, ১১:৫৮ পিএম

টিকার খরচে ২৩ হাজার কোটি টাকার ফারাক পেয়েছে টিআইবি

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ টিকা প্রদানের খরচের ক্ষেত্রে সরকারি হিসাব এবং বেসরকারি সংস্থা টিআইবির হিসাবের মধ্যে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার ফারাক দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত মার্চ মাসে বলেছিলেন, কোভিড-১৯ টিকা ক্রয় এবং বিতরণের ক্ষেত্রে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

নিজেদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ—টিআইবি এ দাবি করেছে।

টিআইবি জানিয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত একজন রোগীকে গড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। 

সরকারি হাসপাতালে এই ব্যয়ের পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ কয়েক গুণ বেশি। বেসরকারি হাসপাতালের এ ব্যয় রোগীর জন্য অর্থনৈতিক বোঝা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘কোভিড মোকাবেলায় ব্যয় সম্পর্কিত কিছু তথ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোটাদাগে উল্লেখ করলেও সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সরকারি সূত্রে তথ্যের অনুপস্থিতিতে নির্ভরযোগ্য অন্য সূত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, ক্রয়সহ সার্বিক টিকা কার্যক্রমে খরচ হওয়ার কথা ১৩ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু মন্ত্রী বলেছেন খরচ হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই তারতম্যের পরিপেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রকৃত ব্যয়ের তথ্য উন্মুক্ত না করার পেছনে তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা ও গোপনীয়তার সংস্কৃতির পাশাপাশি সম্ভাব্য অনিয়ম-দুর্নীতি আড়াল করার প্রয়াসও অন্তর্নিহিত কি না। ’

মঙ্গলবার ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সুশাসন : অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার পক্ষে এসব কথা বলা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংস্থার উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো শাহজাদা এম আকরামের তত্ত্বাবধানে প্রণীত গবেষণাটি উপস্থাপন করেন একই বিভাগের গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন ও গবেষণা সহযোগী কাওসার আহমেদ। গবেষকদলের অপর সদস্য হলেন একই বিভাগের গবেষণা সহযোগী রাবেয়া আক্তার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও টিকা কার্যক্রম এবং করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গ্রহণ করা প্রণোদনা কার্যক্রমে এখনো নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সুশাসনের বিশেষত অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ অব্যাহত আছে। বিশেষ করে, সংকট মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সাড়া দেওয়া এবং সেবা সম্প্রসারণ করা হয়নি; যা ভবিষ্যৎ নতুন কোনো ঢেউ মোকাবেলায় অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

সুশাসনের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে গবেষণায় পাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হিসেবে বলা হয়, টিকা কার্যক্রমে অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি। গত বছর জুলাইয়ে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে টিকা প্রতি তিন হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। গত ১০ মার্চ গণমাধ্যমে টিকা কার্যক্রমে মোট ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন। অথচ গবেষণায় দেখা যায়, টিকা ক্রয় ও টিকা কার্যক্রমের প্রাক্কলিত মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা; যা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেওয়া হিসাবের অর্ধেকেরও কম। আবার শুধু একটি দেশের ক্ষেত্রে টিকার ক্রয়মূল্য প্রকাশ না করার শর্ত থাকলেও অন্যান্য উৎস থেকে কেনা টিকার ব্যয় এবং টিকা কার্যক্রমে কোন কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি।

গবেষণা প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের তথ্য দেওয়া হয়। তবে এখনো সুশাসনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব চ্যালেঞ্জ এই কার্যক্রমের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল, বিশেষত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করছে। টিকাসহ চিকিৎসাব্যবস্থা ও প্রণোদনা কার্যক্রমে সবার জন্য সমান প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না করায়, সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এলাকা, শ্রেণি, লিঙ্গ ও জনগোষ্ঠীভেদে বৈষম্য রয়ে গেছে। যা দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবা থেকে বঞ্চিত করছে এবং হয়রানি ও আর্থিক চাপে ফেলেছে।

প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়নেও সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান থাকায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনার সুফল প্রত্যাশিতভাবে পৌঁছয়নি। স্বচ্ছতার ঘাটতি একদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির ঝুঁকি তৈরি করেছে, অন্যদিকে সংঘটিত দুর্নীতিকে আড়াল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেবা কার্যক্রমে অভিযোগ নিরসনের ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা নিরসনে বা অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের দুই বছর পার হলেও প্রয়োজনের চেয়ে পরীক্ষাগার স্বল্পতা, সক্ষমতার অধিক সেবাগ্রহীতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে নমুনা পরীক্ষায় বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। তাদের গবেষণা বলছে, ২৬.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতা কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং ১৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে নমুনা প্রদানের সময় পরীক্ষাগারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মানা, নমুনা দিতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ফিরে আসা, পরীক্ষাগারে কর্মীদের দুর্ব্যবহার, বাসা থেকে নমুনা দিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, নমুনা দিতে একাধিকবার কেন্দ্রে যাওয়া, ভুল প্রতিবেদন দেওয়ার কারণে পুনরায় পরীক্ষা করতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি অভিযোগের কথা জানা গেছে।

নমুনা পরীক্ষার পর রিপোর্ট পেতে গড়ে ২.৫ দিন (সর্বোচ্চ ৯ দিন) এবং পরীক্ষাগারে নমুনা দিতে গিয়ে গড়ে তিন ঘণ্টা (সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা) অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষাগারের স্বল্পতা, অতিরিক্ত ভিড়, নমুনা প্রদানে জটিলতা, অতিরিক্ত খরচ ইত্যাদি কারণে নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে জনগণকে,  বিশেষত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও এর প্রতিবেদন পাওয়া এবং প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় নেগেটিভ সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়া এবং চিকিৎসা সুবিধার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বৈষম্যের তথ্য তুলে ধরা হয়।

এ ছাড়া বলা হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের দুই বছরে পরীক্ষাগার ও আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বাড়ানো হলেও তা অল্প কিছু জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখনো ৩৪টি জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষার সুবিধা নেই। ২০২০ সালের জুন মাসে সরকার থেকে সকল জেলা হাসপাতালে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা স্থাপনের ঘোষণা করা হলেও এখনো ৩১টি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়নি। আইসিইউ শয্যাসংখ্যা ৯৪টি বাড়ানো হলেও তা বেশির ভাগই শহরকেন্দ্রিক এবং বেসরকারি। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ছয় হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের আওতায় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, নমুনা পরীক্ষাগার স্থাপন, টিকা ও বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয় করার কথা থাকলেও প্রায় দুই বছর পরও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি কোভিড মোকাবেলায় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অনুদানের মাত্র ৬.৭ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে টিকা কেন্দ্রগুলোতে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে যথাসময়ে বা দ্রুত টিকা পেতে ১০.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৬৯ টাকা ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে। এ ছাড়া প্রবাসীরা টিকার নিবন্ধনের জন্য বিএমইটি নম্বর পেতে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত  ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে টিকা না নিয়েও টাকার বিনিময়ে প্রবাসীরা টিকা সনদ সংগ্রহ করেছেন। এমনকি একটি গ্রুপকে ফেসবুক পেজে প্রবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে টিকা ও টিকার সনদ দেওয়ার প্রচার চালাতে দেখা গেছে। এ ছাড়া নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ৮৬.৪ শতাংশ টিকাগ্রহীতাকে অন্যের সহায়তায় নিবন্ধন করতে হয়েছে। নিবন্ধন ও টিকা গ্রহণ করতে যাতায়াত বাবদ একজন টিকাগ্রহীতার মোট গড় খরচ ১০৬ টাকা, যা দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের এক দিনের আয়ের চেয়ে বেশি।

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ উত্তরণে টিআইবি ১০ দফা সুপারিশ করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো টিকা প্রাপ্তির উৎস, ক্রয়মূল্য, বিতরণ ব্যয়, মজুদ ও বিতরণ সম্পর্কিত তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে; কোভিড-১৯ চিকিৎসা ও টিকা সম্পর্কিত সকল প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং কোভিড-১৯ চিকৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে সরকারি ও প্রকল্পের বরাদ্দ যথাযথভাবে দ্রুততার সাথে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি জেলায় আইসিইউ শয্যা, আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন শেষ করতে হবে।

Link copied!