জুলাই ৩, ২০২১, ০৭:৩৫ পিএম
বাংলাদেশকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে দেশটির নতুন প্রজন্ম। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন দেখে বড় হয়েছে এই প্রজন্ম। তারা অভূতপূর্ব এক উন্নয়নের যুগে জন্ম নিয়েছে এবং নতুন করে তাদের মূল্যবোধ তৈরি করছে। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ এই প্রজন্মের সদস্য।
সাম্য ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর সকলে পাচ্ছে চাকরি। বিভিন্ন এনজিও ও আইসিটি খাতে নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্টার্টআপ গুলোর কল্যাণে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন সব বাজার। আজ বিশ্বের বুকে ঢাকা বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক শহর।
বাংলাদেশে যে কোন একটি জাতীয় দৈনিক খোলার পর সেখানে দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা নেই, এমন খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও এই সাফল্যের কথাগুলো দেশের বাইরে খুব কমই প্রচার হয়। আর কখনও প্রচার হলেও বিষয়টিকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নিরিখে মাপা হয়।
কিন্তু বেশ দ্রুততার সঙ্গেই বাংলাদেশ তার নিজস্বতা বজায় নিয়ে চলতে শিখেছে এবং আজ বাংলাদেশের ওপর আগের মত কোন প্রভাব নেই ভারতের।
এ বিষয়ে বলার অন্যতম কারণ হচ্ছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে ভারতের জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণনা করছেন অনেকেই। তাদের মূল প্রশ্ন, ঢাকার বিশ্বাসযোগ্যতাকে নিয়ে, যা চীনের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
ভারত-চীন সম্পর্ক
অবশ্য এই বিষয় নিয়ে কয়কে বছর ধরেই আলোচনা চলছে। ২০২০ সালের ১৭ এপ্রিল চীনের বিনিয়োগে অবরোধ আরোপ করে ভারত। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরে ৫মে সীমান্তে চীনের সৈন্যদের সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যের সংঘর্ষ হয়। চীনকে কেন্দ্র করে ভারতের অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যুদ্ধে গিয়ে প্রথমসারিতে দাঁড়িয়ে বুক পেতে দিতে রাজি ছিল। ভারতের অভ্যন্তরে চীনের পণ্য বর্জনের হিড়িক পড়ে যায়। দিল্লির ডিফেন্স কলোনি তো যুদ্ধই ঘোষণা করে দেয়। কোভিড১৯ সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতে বেড়েছে চীন বিদ্বেষ। আর এ কারণেই এবার ভারতের গণমাধ্যমে আক্রমণের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ।
চীন যে বাংলাদেশকে শুল্ক মুক্ত সুবিধা দিচ্ছে, এটি প্রমাণ করে ভারতের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর কূটনৈতিকদের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে চীন। আর চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অতীত বাণিজ্যের সম্পর্ক বিশ্লেষণে আরও একবার নিশ্চিত হওয়া যায়, বিষয়টি ভারতের জন্য হুমকিজনক বটে। অবশ্য এর কোনটি এখন পর্যন্ত পাকাপোক্ত হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে মাত্র।
চীন এবং ভারত তাদের কর্তৃত্ব নিয়ে যেই চিন্তা করছে তার থেকে দূরে সরে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে তাদের আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নয়ন করছে। বাংলাদেশের জন্য বেইজিং অথবা দিল্লি কোন বাছাই করার বিষয় নয়। বরং এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু সম্পর্ক ইতোমধ্যেই স্থাপন করেছে বাংলাদেশ যা এই দেশের অর্থনীতির চাকা আরও সচল করেছে। বাংলাদেশ তার সবচাইতে বেশি আমদানি করে চীন এবং ভারত থেকে। আর রফতানি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা দেশগুলোর একটি চীন। কিন্তু বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ৫.৫ শতাংশ রয়েছে চীনের। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগ রয়েছে ২০.৯ শতাংশ।
যখন বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ভালো সম্পর্ককে দিল্লির ক্ষতি হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেখানে দিল্লির সিদ্ধান্ত প্রণেতারা চীনের মতই বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগী হতে পারে বিনিয়োগের মাধ্যমে। বাংলাদেশে যে পরিমাণে চীনের প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ রয়েছে, তা একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে ভারতের জন্য।
অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সময় ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশের প্রতি নজর দেয়া উচিত এবং এখানে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে এটি সম্ভব হবার নয়। চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যবসায় টিকে থাকার মত অবস্থা নেই ভারতের এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কোম্পানিগুলোর। আর এখানেই ভারত কি করতে পারে এবং ভারতকে কি করতে দেখতে চায় সকলে সেখানে পার্থক্য তৈরি করছে। আর বিবেচনা না করে মানুষের চাওয়ার ওপর ভিত্তি করে যখন এই শূন্যস্থান পূরণে উদ্যোগী হয় ভারত, তখন তা আরও সমস্যার সৃষ্টি করে। আফ্রিকায় ১০ বছর আগে এভাবেই চীন ভারতের প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘটে যা শেষ পর্যন্ত আফ্রিকার দেশগুলোতে দুর্নীতি ও ব্যর্থতার মাধ্যমে শেষ করতে হয় ভারতকে।
অবশ্য ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সুখবরও রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনও অনেক দৃঢ় যেখানে চীন ও ভারতের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় ভারতকে এগিয়ে রেখেছে। দুই দেশ যদি শুধু নিজেদের মধ্যে পরিবহন আদান প্রদান চুক্তি করে এবং শুল্ক মুক্ত পণ্য আমদানি রফতানি শুরু করে তাহলে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বেড়ে দাঁড়াবে ১৭২% এবং বাংলাদেশের জন্য ভারতে বাণিজ্য বাড়বে ২৯৭%!
এই বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকদের আয় বাড়বে এবং নিম্ন আয়ের মানুষ স্বল্প মূল্যে পণ্য পাবে সম্প্রতি সমুদ্র পথ ও রেলপথ নিয়ে যেই চুক্তি হয়েছে তা এই বিষয়গুলোকে আরও চাঙ্গা করবে। নাক সেটকাবার কিছু নেই। এই চুক্তিগুলো বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ভারত-বাংলাদেশ 'বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল এবং ইকোনমিক কোঅপারেশন'-এর সদস্য। ৭ দেশ নিয়ে গড়ে ওঠা এই সংস্থার লক্ষ্য দেশগুলোর মধ্যে শুল্কমুক্ত পণ্য ও সেবা সরবরাহ ব্যবস্থা প্রবর্তন। বিমসটেক দেশগুলো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করলে তাদের বাণিজ্য ৫০০ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীন এ বিষয়ে পেছনে থেকে বাকবাকুম করা ছাড়া আর কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। আর সে কারণেই রাজনীতিবিদদের বিশেষ বিষয়ে নজর না দিয়ে, জাতীয় উন্নয়ন ও লাভের দিকে নজর দেয়া উচিত।
এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দিল্লির 'মুক্তবাণিজ্য বিরোধী' চিন্তা। ভারতের রাজনীতিবিদরা আজ 'আত্মনির্ভর ভারত' করার যেই চেষ্টা করছে, সেখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। এটি বেশ স্পষ্ট যে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়।
অন্যদিকে ঢাকা তার রফতানি মুখি প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে। কিন্তু এখানেও নিজস্ব এত বড় বাজার নেই যার মাধ্যমে নিজে থেকেই বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব হবে। সময় এসেছে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে মুক্ত অর্থনীতি ও বৃহৎ এই বাজার নিয়ে কাজ করার। এ ক্ষেত্রে এখনও অনেক ব্যবসায়ী বাঁধ সাধছেন। সবচাইতে বেশি সমস্যা তৈরি করছেন রাজনীতিবিদরা।