জানুয়ারি ২০, ২০২২, ১২:০৭ এএম
এতদঞ্চলে রেলওয়ের ইতিহাস ১৫৯ বছরের। স্বাধীন বাংলাদেশে রেলওয়ের বয়স ৫০ বছর। এই ৫০ বছর রেলের ইতিহাস অম্লমধুর। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি ঘটেছে বাংলাদেশের। উন্নয়নের গতির সাথে তাল মেলাতেই নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নও সমানতালে চলছে। সে লক্ষ্যেই গণপরিবহনের সবচে সহজলভ্য ও জনবান্ধব রেলের উন্নতির কথা চিন্তা করেছিল সরকার। স্লথগতির ট্রেনকে বুলেট গতি প্রদানের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছিল মহাপরিকল্পনা।
রাজধানী ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে মাত্র এক ঘণ্টায় যাওয়ার জন্য বুলেট ট্রেনের ঘোষণা দেওয়া হয় চার বছর আগে। কিন্তু সেই স্বপ্নের সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের পর এখন সে প্রকল্প থেকে সরে এসেছে রেল মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরইমধ্যে বুলেট ট্রেনের সমীক্ষার নামে শত কোটি টাকা খরচও করা হয়ে গেছে। উপরন্তু জনবল সংকটের কারণে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে রেলওয়ের ১১৬টি স্টেশন।
২০১৭ সালে বুলেট ট্রেন প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয় করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর রেল মন্ত্রণালয় এখন মনে করছে, এই মেগা প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগে বর্তমান সিঙ্গেল লাইনগুলোকে ডাবল লাইনে রূপান্তর সহ চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন অবশ্য দাবি করেছেন, বুলেট ট্রেন প্রকল্পটি একেবারে বাতিল হয়ে যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ৪৮৩টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে অপারেটিং (রেলওয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত) স্টেশন রয়েছে ৩৫৯টি। বাকি ১২৪টি স্টেশন ডি ক্লাশ (স্বল্প বিরতিকালীন)। এরমধ্যে স্টেশন মাস্টার ও অন্যান্য জনবলের অভাবে বন্ধ রয়েছে ১১৬টি স্টেশন। বন্ধ স্টেশনগুলো চালুর উদ্যোগ না নিয়ে ২০১৭ সালে বুলেট ট্রেন চালুর প্রকল্প হাতে নিয়েছিল রেলওয়ে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার নামে ১১০ কোটি টাকা যে খরচ করা হয়েছে, এর পুরোটাই জলে গেছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রেলের দীর্ঘদিনের সমস্যা নিয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীদের প্রয়োজনের নিরিখেই বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট ৪৬৬টি স্টেশন স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় রেলওয়ের কর্মী ও স্টেশন মাস্টারের অভাবে এসব স্টেশন সচল রাখা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া অধিকাংশ স্টেশন পরিত্যক্ত হয়েছে। অথচ বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন দেখার নামে শত কোটি টাকা ব্যয় না করে বন্ধ স্টেশন গুলো পুনরায় চালু করলে কিছুটা হলেও যাত্রী সেবার মান বাড়তো।
কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, বছরের কোনো না কোনো সময় অভিজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরে যায়। কিন্তু নতুন করে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় না। ফলে অনেক স্টেশনই বন্ধের উপক্রম দেখা দিয়েছে। দ্রুততম সময়ে নতুন নিয়োগ শুরু না হলে ২০২২ সালের মধ্যে আরও অনেক স্টেশন বন্ধ হয়ে যাবে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, মাস্টারের অভাবে অনেক স্টেশন পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে গেছে। জনবল নিয়োগ দিলে এই স্টেশন গুলো পুনরায় চালু করা সম্ভব।
স্টেশন বন্ধ থাকার কারণে রেলের পরিচালন সময় বেড়েছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্ধ স্টেশন অতিক্রম করার সময় ট্রেনের গতি কমিয়ে আনা হয়। বন্ধ থাকা প্রতিটি স্টেশন পার হতে ট্রেনের সময় অপচয় হচ্ছে।
বন্ধ থাকা স্টেশনের যন্ত্রপাতি ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্ধ থাকা স্টেশনের যন্ত্রপাতি ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোক আছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৪টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৬টি স্টেশন নতুন করে বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ১৬টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে ২০০৮ সাল থেকে। ২০০৯ সালে ২৬টি এবং ২০১০ সালে ৩৪টি। পরবর্তীতে ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ১১৬টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, মোট রেলস্টেশনের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ২২৮টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৫৫টি স্টেশন রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৭০টি বন্ধ স্টেশন পশ্চিমাঞ্চলে। পূর্বাঞ্চলে বন্ধ স্টেশন রয়েছে ৪৬টি। রেলওয়ের চার শ্রেণীর স্টেশন রয়েছে।
রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, এ ও বি ক্লাশ স্টেশন রেলওয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এছাড়া ডি ও হল্ট ক্লাশ স্টেশন মাস্টার বিহীন স্বল্প বিরতির জন্য ব্যবহার করা হয়। রেলওয়ের ১২৪টি স্টেশন ডি ও হল্ট ক্লাশের স্টেশন রয়েছে। এছাড়া আংশিক ও এক/দুই শিফট করে বন্ধ রয়েছে অর্ধশত স্টেশন। এসব স্টেশনের অধিকাংশই মাস্টার সংকটের কারণে চালু করা যাচ্ছে না।
রেলওয়ের পরিচালন বিভাগ সূত্র জানায়, একটি স্টেশনে কমপক্ষে তিনজন মাস্টার থাকার নিয়ম রয়েছে। তাদের সহযোগিতা করেন আরও তিনজন পয়েন্টসম্যান। সব মিলিয়ে সাতজন নিয়ে একটি স্টেশন সচল রাখা হয়। তারা পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন। বন্ধ থাকা প্রতিটি স্টেশনের প্যানেল বোর্ড বা সিগ্যাল কেবিন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এটি দিয়ে রেল চলাচলের দিকনির্দেশনা দেওয়া হতো। এসব যন্ত্রের দাম কয়েক লাখ টাকা।
পশ্চিমাঞ্চলের ৭০ টি স্টেশন বন্ধ
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে ২৫৬টি স্টেশনের মধ্যে বন্ধ রয়েছে ৭০টি। এর মধ্যে লালমনিরহাট বিভাগে বন্ধ হয়ে যাওয়া ২০টি স্টেশন হলো: আলতাফনগর, ভেলুরপাড়া, কাহালু, নলডাঙ্গা, চৌধুরানী, বাদিয়াখালী, কাউগাঁ, মন্মথপুর, খোলাহাটা, অন্নদানগর, ভোমরাদহ, শিবগঞ্জ, ভোটমারী, বাউরা, পাটগ্রাম, আদিতমারী, মহেন্দ্রনগর, ত্রিমোহনী, রাজারহাট ও উলিপুর
এছাড়া পাকশী বিভাগে ৫০টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা-দর্শনা রুটে ৬টি বন্ধ স্টেশন হলো- ফুলতলা, চেংগুটিয়া, রূপদিয়া, যশোর ক্যান্টনমেন্ট, মেহেরুন্নেসানগর ও আনসারবাড়ীয়া, দর্শনা-ঈশ্বরদী রুটে ৪টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এগুলো হলো-জয়রামপুর, মোমিনপুর, মুন্সীগঞ্জ ও মিরপুর।
যশোর-বেনাপোল রুটে নাভারণ ও ঝিকরাগাছা দুটি স্টেশন বন্ধ, ঈশ্বরদী-সান্তাহার রুটে মালঞ্চি, ইয়াসিনপুর, বাসুদেবপুর ও সাহাগোলা চারটি স্টেশন দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সান্তাহার-পার্বতীপুর রুটে তিলকপুর, জামালগঞ্জ, ভবানীপুর ও হিলি এই চারটি যাত্রীবাহী স্টেশন বন্ধ রয়েছে।
পার্বতীপুর-চিলাহাটি রুটের বেলাইচড়ি, দারোয়ানি, মির্জাগঞ্জ, ঈশ্বরদী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে নন্দনগাছি ও নাচোল, ঈশ্বরদী-জামতৈল-সিবাজার রুটে শরৎনগর স্টেশন, পোড়াদহ-গোয়ালন্দঘাট রুটে জগতি, চড়াইকোল, মাছপাড়া, বেলগাছি, গোয়ালন্দবাজার, খোকসা ও সাতৈরসহ ৭টি স্টেশন দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ রয়েছে।
কালুখালী-ভাটিয়াপাড়াঘাট রুটে বহরপুর, নলিয়াগ্রাম, বোয়ালমারী বাজার স্টেশন, কাশিয়ানী-গোবরা রুটে ৫টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এগুলো হলো-চাপতা, ছোটবাহিরবাগ, চন্দ্রদিঘলিয়া, বোড়াশী ও গোবরা স্টেশন। মাঝগ্রাম-ঢালারচর রুটে দাশুড়িয়া, টেবুনিয়া, দুবলিয়া, তাতীবান্ধা ও কাশিনাথপুর স্টেশন, পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-ভাঙ্গা রুটে খানখানাপুর-তালমা-পুকুরিয়া।
পূর্বাঞ্চলের ৪৬টি স্টেশন সম্পূর্ণ বন্ধ
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ২২৮টি স্টেশনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৯টি ও চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। ঢাকা বিভাগে আখাউড়া-সিলেট-ছাতকবাজার রুটের লস্করপুর স্টেশনটি দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত বন্ধ রয়েছে। এরপর এই রুটে টিলাগাঁও ও ইটাখোলা স্টেশন দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া ভাটেরাবাজার, আফজালাবাদ, খাজাঞ্চিগাঁও ও ছাতকবাজার ১০ বছর যাবত সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।