জানুয়ারি ৫, ২০২২, ০৩:৫৭ পিএম
প্রায় বিশ বছর আগের মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি (২৪) হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিলেন নিহতের বাবা ও চাচা। সাক্ষীরা হলেন, নিহত তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম ও বড় চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম। বুধবার ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে তারা সাক্ষ্য প্রদান করেন। তবে এদিন মাহবুব করিমের সাক্ষ্য শেষ হলেও রেজাউল করিমের তা শেষ হয়নি। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারী সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছে আদালত।
অভিকে বিয়ের কথা জানায় তিন্নি
সাক্ষ্যের জবানবন্দিতে তিন্নির বাবা মাহবুব করিম বলেন, ‘তিন্নি আমাকে ২০০২ সালের ৫ নভেম্বর রাত ৯ টার দিকে টেলিফোনে বলে ধানমন্ডি যাওয়ার জন্য। আমি সেখানে যাই। তিন্নি আমাকে বাবু নামের একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিন্নি তখন অলরেডি জানতো যে, ওই বাবুই অভি। আমাকে তিন্নি এটাও বলে যে, বাবু ভাই হচ্ছেন অভি। সে আমাকে অনেক সম্মান করলো। জুস খাওয়ার জন্য জোরাজোরি করতে থাকেন। পরে আমি তিন্নিকে নিয়ে বাসায় চলে আসি। আসার সময় আমি তিন্নিকে জিজ্ঞাসা করি, অভির সাথে এই ঘুরাঘুরি কেন? তিন্নি বলে- অভির সাথে তার অ্যাফেয়ার। অভি তাকে বিয়ে করবে।’
ঈদের পর বিয়ের আশ্বাস দেয় অভি
মাহবুব করিম বলেন, ‘তখন আমি তিন্নিকে তার স্বামী পিয়ালের কথা বলি। তাকে বলি, এখন তুমি কিভাবে অভিকে বিয়ে করবা। আমি বলি, এমন বিয়া মানব না। তিন্নি বলে, আমি পিয়ালের সাথে থাকতে চেয়েছি কিন্তু সে আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। পরের দিন রাত ১০ টায় অভি আমাকে তিন্নি-পিয়ালের বাসায় ডেকে নিযে যায়। সেখানে পিয়াল ছিল। পিয়ালের ভাই রিয়াল এবং কাজের দুই মেয়েও ছিল। অভি আমাকে বলে, পিয়ালের কাছ থেকে তিন্নির তালাক সে নিয়ে নিবে। তারপর অভি পিয়ালকে ধমকের সুরে বলে, সে ২ টা ডিভোর্স লেটার ব্যাকডেটে পাঠাবে। সেগুলো পিয়াল ব্যাকডেট দিয়ে সিগনেচার করে নিবে। এরপর অভি পিয়ালকে জিঙ্গাসা করে,‘এই বাসার মধ্যে তোমার কি কি জিনিস আছে? পিয়াল বলে এই বাসায় যা আছে সবই তার।
তারপর অভি বলে -রোজার ঈদের পরেই সে তিন্নিকে বিয়ে করবে। তখন রোজা চলতেছিল। অভি বলে মেয়ে আনুষ্কা পিয়ালের কাছে থাকবে। তারপর অভি অদ্ভুত ধরণের চেহারা করে তিন্নিকে চার্জ করে বলে- সে কত জনের সাথে রাত যাপন করেছে। এটা তাকে খুলে বলতে। তিন্নি আমার সামনে সব স্বীকার করে। তারপর অভি তিন্নিকে বলে তার ব্যাংকে কত টাকা আছে? তিন্নি বলে ৭০ হাজার টাকা আছে। মাঝে পিয়াল বলে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ছিল। তখন অভি তিন্নিকে বলে সে কেন মিথ্যা বললো?
কথা মাঝে পিস্তল বের করে অভি
এক পর্যায়ে পিয়াল অভিকে বলে, অভি ভাই আপনাকে নাকি তিন্নির বাবা দেখে নিবে। অভি সাথে সাথে পকেট থেকে পিস্তল বের করে আমার মাথার ডান পাশে তাক করে বলে- ওই সালার বেটা, তোর সাহস আছে আমাকে দেখে নিবি? আমি তখন ভয়ে বলি, অভি ভাই আমি তো আপনারে চিনি না। তখন অভি বলে- এখন বুঝছোস তো আমি কে? এরপর অভি পিস্তল নামায়। তারপর আমাকে বলে- এই বাসায় আর আসবি না। আরো বলে সে তিন্নিকে নিয়ে হজ্জ করতে যাবে। আমি তখন বলি-তুমি কোন আইনে বিয়ে ছাড়া তিন্নিকে নিয়ে ওমরাহ করতে যাবে? পরে আমাকে চলে যেতে বললে আমি রাত ১২ টার দিকে বাসায় চলে আসি। এদিন সম্ভবত ৬ নভেম্বর তারিখ ছিল।
মাহবুব করিম আরো বলেন,‘৭/৮ তারিখ আমি আর তিন্নি কেউ কারো বাসায় যায়নি বা দেখা হয়নি। দুইজনই আমরা লজ্জা পাচ্ছিলাম। ১০ তারিখ সন্ধ্যার পর আনুমানিক ৭ টা বা সাড়ে ৭ টার সময় তিন্নি আমার বাসায় আসে। সেখানে আমার বাবা-মাও থাকতো। তিন্নিকে কিছু খেতে দেয়া হয়। ও বলে সে রোজা রাখে। তিন্নি ৫-৭ মিনিট, বেশি হলে ১০ মিনিট ওই বাসায় ছিল। দাদাকে সে পা ধরে সালাম করে। বুকে জড়িয়ে আদর করে। আমাকে সরি বলে। বলে যে, ওই দিনের জন্য দুঃখিত। তাকে মাফ করে দিতে বলে। তারপর ছাদে গিয়ে আমার মা যেখানে মারা গিয়েছিল, সেখানে গিয়ে সালাম করে। তিন্নি দাদা, দাদির কাছেই বড় হয়েছিল। এরপর আমি তিন্নিকে থাকতে বলি। তিন্নি বলে অভি এসে নাকি ফাংশনে নিয়ে যাবে। তিন্নি বলে- তাকে যেতে হবে। তারপর তিন্নি চলে যায়। বাসার কাজের ছেলে মহসিন তিন্নিকে নামিয়ে দেয়। তখন আটটা বাজে হয়তো।’
পত্রিকায় লাশের ছবি দেখে শনাক্ত
তিনি বলেন,‘৯ টার সময় তিন্নির বাসার কাজের মেয়ে বীনা আমার বাসায় এসে জিজ্ঞাসা করে তিন্নি আপু কোথায়? আমি বলি, ও তো চলে গেছে আরো আগে। বীনা বলে, অভি ভাই আইসা তিন্নিকে না পাইয়া রাগারাগি করতেছে। রাত ১০ টা পর্যন্ত বীনা ২/৩ বার আসে তিন্নিকে খুঁজতে। আমরাও অস্থির হয়ে যায়। খুঁজতে শুরু করি। রাত ১১ টার দিকে আব্বা বড় ভাইকে বলে- তোরা রাতে বাসায় থাকিস না, অভি এসে শাসিয়ে গেছে। আব্বা আমাদের কোথাও চলে যেতে বলে। ভাইয়া তখন আমাকে রামপুরার এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যায়। পরেরদিন আমাকে ওখানে রেখে ভাইয়া কলাবাগানের বাসায় চলে আসে। ১৫ তারিখ পর্যন্ত আমি ওখানেই ছিলাম। ১৫ তারিখ সকাল ৯/১০ টার সময় মামাতো ভাই পেপারে তিন্নির লাশের ছবি দেখে আমাকে দেখায়। আমি লাশ দেখে চিনতে পারি। তারপর আমরা কেরানীগঞ্জ থানায় যাই। আমি লাশ দেখতে চাই। তার পরদিন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন করে জুরাইন কবরস্থান থেকে। আমরাও ছিলাম। লাশ চিনতে পারি। পরে আমরা পত্রিকায় এবং মানুষের মুখে শুনতে পারি যে, অভিই তিন্নিকে হত্যা করেছে। তিন্নির লাশ যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয় সেদিন সকাল বেলা কলাবাগানে অভির সাথে আমার ভাইয়ের দেখা হয়। অভি বলেছে- তিন্নিকে খুঁজতে হবে না। অভি ভাইয়াকে ৫০০ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু ভাইয়া নেয়নি। এরপর তিনি বলেন এই মামলার জবানবন্দি। ন্যায় বিচার চাই। এরপর আসামি পক্ষে রাষ্ট্র নিয়ুক্তিয় আইনজীবী তাকে জেরা করেন। জেরা শেষ হওয়ার পর তিন্নি বড় চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম আদালতে জবানবন্দি দেয়া শুরু করেন। আংশিব জবানবন্দি দেয়ার পর তা অব্যাহত থাকাবস্থায় আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ঠিক করেন।
এর আগে গত ১৫ নভেম্বর এ মামলায় রায় ঘোষণার দিন ঠিক করা হয়। সেদিন তিন্নির বাবা ও চাচা আদালতে এসে মামলা রায়ের পর্যায়ে যাওয়ার বিষয় কিছু জানেন না এবং তারা সাক্ষ্য দিতে চান মর্মে জানান। তখন আদালত মামলাটি রায় থেকে উত্তোলন করে ৫ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য্য করেন।
পলাতক রয়েছে অভি
মামলার একমাত্র আসামি জাতীয় পার্টি সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি। যিনি বিদেশে পলাতক রয়েছেন। মামলা থেকে জানা যায়, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি (২৪) খুন হন। বুড়িগঙ্গার চীন-মৈত্রী সেতুর নীচে তার লাশ পাওয়া যায়। একই বছরের ১১ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাতনা আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক ছাত্রনেতা ও সাংসদ গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে তিন্নির স্বামী সাফকাত হোসেন পিয়ালসহ ৫ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অব্যাহতি পাওয়া অপর আসামিরা হলেন, এবাইদুল্লাহ, গাজী শরিফ উদ্দিন, সফিকুল ইসলাম জুয়েল ও সোমনাথ সাহা।
মামলায় তিন্নির দুই গৃহকর্মীর সাক্ষী হিসাব ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভি এখন কানাডায় রয়েছেন। '৯২ সালে রমনা থানায় দায়ের করা একটি অস্ত্র মামলার ১৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের রায়ের পর হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান অভি। অভি তিন্নিকে হত্যার আগে তার স্বামী পিয়ালের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে তাকে ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত 'র্দুর্ধষ' অভি তাকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। বরং বিয়ের জন্য অভিকে চাপ দিলে পরিকল্পিতভাবে তিন্নিকে খুন করে লাশ চীন-মৈত্রী সেতুর নিচে ফেলে রাখা হয়।
মামলায় ২০১০ সালের ১৪ জুলাই অভির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে আদালত। এরপর পলাতক অভি এই মামলা সংক্রান্তে হাইকোর্টে একটি রীট মামলা করলে এই মামলার বিচার দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পরে হাইকোর্ট রীট খারিজ করে দিলে মামলার বিচার আবার শুরু হয়। আদালত এ মামলার বিচারকালে চার্জশিটভূক্ত ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহন করেছেন।