২৬ কোটি টিকা কেনার চেষ্টায় বাংলাদেশ: সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ৫, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম

২৬ কোটি টিকা কেনার চেষ্টায় বাংলাদেশ: সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

করোনার ডেল্টা ঢেউ চলছে এখন দেশজুড়ে। এই আতঙ্কের মধ্যেও স্বস্তির খবর হল, দেশে শুরু হয়েছে গণ টিকাদান কর্মসূচি। ইতোমধ্যে চীন এবং আমেরিকা থেকে এসেছে টিকা। করোনা মহামারী, কোভিড-১৯ টিকা আমদানি সহ কূটনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্য রিপোর্টের সাথে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবুল কালাম আব্দুল মোমেন।

বাংলাদেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে ২৬ কোটি ডোজ টিকা কিনতে হবে বলে জানান তিনি। এ জন্য টিকার বড় বিক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। বিশেষ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য রিপোর্টের কূটনীতিক প্রতিবেদক ফারজানা ফাহ্‌মী।

https://www.youtube.com/watch?v=97axN6B9u_Q

দ্য রিপোর্ট: ভারত থেকে তিন কোটি টিকা আসার কথা, এর অগ্রগতি কতদূর?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী: ভারতের করোনা আউটব্রেক শুরু হয়ে গেলো। তারা তাই তখন ভ্যাকসিন দিতে পারলো না। ৩০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন দেয়ার কথা ছিল। তার মধ্যে কনট্রাক্ট অনুযায়ী তারা মাত্র ৭ মিলিয়ন দিয়েছে। আর বাকি তারা দিয়েছে কিছু গিফট হিসেবে। গিফট তারা বাধ্য হয়ে দিয়েছে। কারণ এক্সপোর্ট ব্যান হয়ে যাওয়ায় তখন তাদের দান দেখিয়ে দিতে হয়েছে। এই সব মিলিয়ে ১০.২ মিলিয়ন ভ্যাকসিন আমরা এখন পর্যন্ত পেয়েছি ভারতের কাছ থেকে। ভারত কিন্তু কখনোই বলে নাই তারা আমাদের দিবে না। বলেছে যে সাপ্লাইয়ে কিছু ডিজরাপশন হবে। বিশেষ করে জুন-জুলাই এসব সময়ে। এখন তাদের দেশের অবস্থা কিছুটা ভালো, তারা বিপদ উতরেছে বলে মনে হচ্ছে। এ ছাড়াও কাঁচামাল পাওয়া নিয়ে যেই ঝামেলা ওটাও ম্যানেজ হয়ে গিয়েছে তাদের। এখন হয়তো আগামীতে আশা করি তারা তাদের কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী ভ্যাক্সিন দেয়া শুরু করবে।

দ্য রিপোর্ট: টিকা সংগ্রহের উৎস দেশ এখন পর্যন্ত কারা কারা?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী: আমরা গতবছরেই বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্যাক্সিন আনার ব্যবস্থা করি। আমাদের কাছে তখন বিভিন্ন দেশের তথ্য আসা শুরু করে। অনেকে বলে, ওমুক দেশে অনেক ভ্যাক্সিন আছে। যেমন তথ্য আসলো অস্ট্রেলিয়ায় লোক সংখ্যা ২৫ মিলিয়ন, আর তাদের ভ্যাক্সিন আছে ৯৪ মিলিয়ন। স্বাভাবিকভাবেই এত তাদের লাগবে না। আমরা তখন অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলাপ করি। তারা জানালেন 'এত বেশি মজুদ নেই, তবে তাদের কন্ট্রাক্ট করা আছে।' তারা বেশ কিছু দেশকে এই ভ্যাক্সিন দিবে অনুদান হিসেবে। আমরা বললাম আমাদেরকেও দেন। আমারা আশা করছি তারা আমাদেরকে দিবে। জাপানেরও অনেক মজুদ আছে। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমার আলাপ হয়েছে। এবং আলাপটা আই শ্যুড সে ভেরি পজিটিভ এবং তারাও আমাদেরকে সাহায্য করবে। এক্স্যাক্ট কতটুকু দিবেন আমি জানি না। তবে তারা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খুব শিগগিরই হয়তো দিবেন। সো এখন লাইন আপ হচ্ছে। আমেরিকা দিয়েছে ২.৫ মিলিয়ন প্রথম কিস্তিতে। আরও আসবে। সো এখন আমার মনে হয় না ভ্যাক্সিন এর ফ্লোটা থামবে। মোটামুটি উই হ্যাভ মেইড অল দি অ্যারেঞ্জমেন্টস। কখন কোন ভ্যাক্সিন আনা দরকার সেগুলো রেলিভেন্ট মিনিস্ট্রি এটা নিয়ে আলোচনা করবে।

দ্য রিপোর্ট: বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, জার্মান ও সুইডেনে অক্সফোর্ড - অ্যাস্ট্রজেনেকার টিকার মজুদ আছে। বাংলাদেশের চিঠির প্রেক্ষিতে এসব দেশ থেকে টিকা আসার অগ্রগতি কতদূর?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী: আমরা শুনলাম যে ডেনমার্কে অনেক অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাক্সিন আছে, তারা সেটা ব্যবহার করছে না। আমরা এরকম আরও শুনলাম ক্রোয়েশিয়ার কথা। সাতটা দেশের এমন তথ্য পেলাম। আমরা তখন সাথে সাথে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম যে ঐসব অনেকগুলো দেশের কথা মিডিয়ায় আসলেও, তাদের মজুদকৃত টিকার পরিমাণ খুবই কম। জানা গেলো ক্রোয়েশিয়ায় আছে ১০হাজার ভ্যাক্সিন। যেখানে আমাদের ডেইলি প্রয়োজন হয় ২ লাখের। আমাদের দেশটা জনসংখ্যায় অনেক বড়। অনেকেই সেটা বুঝতে চায় না। তারা বলছে ভুটানে একজনও মারা যায়নি। যেখানে ভুটানের জনসংখ্যা ৫/৬ লাখ। আর আমাদের ১৭কোটি! বিশ্বের অষ্টম জনসংখ্যার দেশ। আমাদের ১০ হাজার, ২০ হাজার টিকায় হবে না। ৭০/৮০% করতে চাইলেও আমাদের ভ্যাক্সিন লাগবে প্রায় ২৬ কোটি। ১৩২ মিলিয়ন লোক হবে, যারা দুটো করে ডোজ নিলে ২৬৪ মিলিয়ন ভ্যাকসিন লাগে। আমাদের মার্কেট অনেক বিশাল। ডেনমার্কের শুনলাম ২ লক্ষ মাত্র ভ্যাক্সিন আছে, এর মধ্যে রয়েছে বিশাল লাইন আপ। তো এটা আসলে আমাদের একদিনের খোরাক। মিডিয়ায় বড় বড় লাইন আপ করে বলা হয় এসব দেশের কথা। কিন্তু তাদের পরিমাণতো খুব কম, সেটা আমাদের পোষাবে না। আমরা চাই যাদের বেশি আছে। যেমন আমেরিকার আছে ৮০ মিলিয়ন। তারা ডিস্ট্রিবিউট করছে। আমাদের গুড টার্গেট তারা। এই যেমন অস্ট্রেলিয়াতে শুনছি বিগ অ্যামাউন্ট তারা কন্ট্রাক্ট করে রেখেছে। আমরা ইংল্যান্ডকেও অ্যাপ্রোচ করেছিলাম। কিন্তু তারা সব বিক্রি করে দিয়েছে। তাদের অ্যাস্ট্রেজেনিকা তারা প্রাইভেট কোম্পানিকে বিক্রি করে দিয়েছে। আমার কিনতে হলে মাঝে অনেক মিডেল ম্যান থাকবে। এতে দাম অনেক বেশি পড়ে যাবে। আমরা তো পয়সা দিয়ে কিনে এনে বিনা পয়সায় দেশবাসীকে দিচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রত্যেক দেশবাসীকে আমরা বিনা পয়সায় ভ্যাক্সিন দিবো। অন্যান্য অনেক জায়গায় অনেক টাকা চার্জ করে।

দ্য রিপোর্ট: বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিবছর নেয়া লাগতে পারে টিকা, এ নিয়ে বাংলাদেশ কি ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী: মনে হচ্ছে এই কোভিড-১৯ অনেক বছর থাকবে। আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি এই ভাইরাসটাকে। এ জন্য হয়তো আমাদের অন্যান্য ভ্যাক্সিন যেভাবে নেই, সেভাবেই ভ্যাক্সিন নিতে হতে পারে। সে জন্যই আমরা এপ্রোচ নিয়েছি যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করবো। প্রোডাকশন করার কারণটা হচ্ছে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো যথেষ্ট উপযুক্ত, ভেরি কম্পিটেন্ট। আমাদের এই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো যেনো লোকালি প্রোডিউস করতে পারে সেজন্য আমরা চায়নার সাথে এবং রাশিয়ার সাথে দর কষাকষি করছি, যে আমরা কো-প্রোডাকশনে যেতে চাই। এটা হলে আমাদের ভ্যাক্সিনের গ্যারান্টি থাকবে, সেই সাথে সস্তায় এই টিকাগুলো আমরা পাবো। আমাদের মাথায় আছে এটা। উই আর ওয়ার্কিং অন ইট।

দ্য রিপোর্ট: টিকা দেশে উৎপাদন হলে তখনও কি টিকা বিনা পয়সায় পাবো?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী: আমরা বারবার দাবি করছি যে ভ্যাকসিন 'পাবলিক গুড' হওয়া উচিত। জেনে খুশি হবেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তিনিও বলছেন এটা 'পাবলিক গুড' হওয়া উচিত। কিন্তু ওনার দেশের যে কোম্পানিগুলো আছে উনি তাদের কনভিন্স করতে পারছেন না। হু আইপিও যদি উইথড্র না হয়, তবে এটা করা যাবে না। আমরা সেটার জন্য বিভিন্ন ফোরামে ভীষণ তাগাদা দিয়ে চলছি। ভ্যাকসিনের টেকনোলজিটা আমরা আহরণ করতে চাই। করে নিজেই প্রোডাকশন করতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিনা পয়সায় দিচ্ছেন। দেশের লোককে বিনা পয়সায় দিবেন, বিদেশে হয়তো আমরা বিক্রি করবো, যদি এনাফ প্রোডিউস করা যায়। আমরা অন্যান্য দেশকে তখন সাহায্যও করতে পারবো।

দ্য রিপোর্ট: অন্যান্য দেশ থেকে টিকা কবে নাগাদ আসবে?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী: কোম্পানিগুলো যারা সাপ্লাই করবে, দিইজ আর প্রাইভেট অর্গানাইজেশন। যদিও গভমেন্টের মেজরিটি শেয়ার। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু সরকারের সাথে ডিল করি। আমরা লাইনটা তৈরি করে দেই কেনার। কত টাকা দিয়ে কিনবেন, কোন সময় ডেলিভারি হবে, কখন আমার দরকার, এগুলো সব নির্ভর করবে যারা কিনছে। ওরা প্রাইভেট কোম্পানি আর আমাদের এখানে হেলথ মিনিস্ট্রি এগুলো কিনবে। তারা টাকা পয়সা লেনদেন করেন, ডেলিভারি দেন দরবার করেন। এবং ন্যাচারেলি এটা একটা ব্যবসা। যদিও আমরা শুরু থেকে বলছি এটি 'পাবলিক গুড' হওয়া উচিত। সকলের সাধ্যের মধ্যে যেন থাকে। ধনী দরিদ্র সবার পাওয়ার কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম থেকেই বলছেন, এটা 'পাবলিক গুড' হওয়া উচিৎ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যারা ভ্যাকসিনের মালিক তারা এটায় রাজি না। তারা এটা দিয়ে ব্যবসা করছে। আমাদের দরকার, আর এটা অনেকটা সাপ্লায়ার্স মার্কেট। যারা তৈরি করেন তাদের সংখ্যা কম। তারা তাই এগুলো বিভিন্ন রকম টার্মস কন্ডিশনে বিক্রি করেন। আগে ভাগে টাকা দিয়ে দিতে হবে। আমরা এই যে এখন চায়না থেকে কিনছি। রাশিয়ার সাথে মোটামুটি আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেখানে আমরা কো-প্রোডাকশনের জন্য প্রস্তাব করেছি। তারাও ইন প্রিন্সিপাল রাজি। এখন দেশীয় কিছু কোম্পানির সাথে আলাপ করছি। কোম্পানিরা হিসাব নিকাশ করছে। প্রাইভেট কোম্পানি তাদের একটা হিসাব নিকাশ থাকে। তাদের হিসাব নিকাশ কবে শেষ হবে তা আমার জানা নেই। এর সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।

Link copied!