ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির ফলে সরাসরি প্রভাব পড়বে জনসাধারণে। কৃষিখাত থেকে শুরু করে রপ্তানিখাতও এর আওতায় রয়েছে।যার ফলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নিত্যদিনের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র-এমনটাই মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃষিখাতে বড় ধাক্কা
জ্বালানি তেলে মোট চাহিদার ২১ দশমিক ১৫ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেচ খাতে। এছাড়া হালচাষ, মাড়াই ও পরিবহণ খাতসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ ৭২ হাজার ৫৩৯ টন। যা মোট চাহিদার ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতি লিটার ৬৫ টাকা হিসাবে এ খাতে কৃষকের খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে গত অর্থবছরের চেয়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এ খাতে ডিজেলের চাহিদা ধরা হয়েছে ১১ লাখ টন। ৮০ টাকা হিসাবে এ খাতে কৃষকের খরচ হবে ১০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়ছে। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা বাড়ায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। শুধু মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি খাতে কৃষককে বাড়তি ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি এমন একটা পণ্য যার মূল্য বাড়লে মূলত সবকিছুর দামই বেড়ে যাবে। সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও বিপণন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি দামে পণ্য উৎপাদন করে আবার বাড়তি দামেই বিক্রি করতে না পারলে কৃষক ব্যয় সামলাতে পারবে না। তখন তারা চাষাবাদ কমিয়ে দেবে। এতে উৎপাদন কমে যাবে। সরবরাহ সংকট দেখা দেবে। এতে বাজার অস্থির হয়ে উঠবে।
রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি
তেলের দাম বৃদ্ধিতে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের ব্যয়ও ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়েছে। যার ফলে আগামীতে রপ্তানি খাতে বড় ধরনের ভর্তুকি দিয়ে চলতে হবে বলে জানায় ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বর্তমানে রপ্তানিতে প্রতিযোগীতা চলছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে বাড়তি ব্যয় হলে বায়ার চলে যাবে। আর আমরা সাময়িকভাবে পণ্যের দাম কমিয়ে রাখছি। কিন্তু এভাবে ভর্তুকি দিয়ে চলছে অনেক খাত বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য।
পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি
তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়তি গুণতে হবে গণপরিহনের যাতায়াতকারীদের। প্রতিদিন রাজধানীর অভ্যন্তরে প্রায় ৩০ লাখ যাতায়াত করে। সে হিসেবে বাড়তি ৬ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে শুধু রাজধানীতেই।
পল্লী বিদ্যুতে প্রভাব
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল এবং ২ লাখ ৭০ হাজার বৈদ্যুতিক পাম্প রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১০ থেকে ১৬ লাখ টন ডিজেল সেচে ব্যবহার করা হয়। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে ডিজেলের দাম বাড়ে। ডিজেল ও সার পাচার হয়।
ডিএই’র এক উপপরিচালক বলেন, চলতি মৌসুমে সার ও ডিজেল সংকট নিরসনে সরকার বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সার ও ডিজেলের ব্যাপক মজুদ রয়েছে। এসবের চোরাচালান ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
আর এই দাম বৃদ্ধির ফলে পল্লী বিদ্যুতে প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, কৃষি খাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯ লাখ ৫ হাজার ৬২৩ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে। যা ওই সময়ে মোট জ্বালানি চাহিদার ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যবহৃত হয়েছে ১০ লাখ ৯০ হাজার ৯০৩ টন। যা ওই বছরের চাহিদার ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে ডিজেলের ব্যবহার ছিল ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৬ টন। যা ওই সময়ের চাহিদার ১৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যবহার কমে দাঁড়ায় ৯ লাখ ৯০ হাজার ৭৫২ টন। যা ওই বছরের চাহিদার ১৮ শতাংশ।