দেশে নানান পদক্ষেপের পরও উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মানুষের আয় যতটা না বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে খাবারের তালিকা কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যার ফল হিসেবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
চলমান অর্থনৈতিক সংকট এবং লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে দেশের চার কোটি মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছে ঋণ করে।
সম্প্রতি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা জরিপে সংকটের এমন চিত্র উঠে এসেছে। ২০২২ সালের জুনের ১৫ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার খানার ওপর এই জরিপ চালায় সংস্থাটি।
বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ মানুষ ঋণ করে তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছেন। এতে গ্রামের ২৮ শতাংশ এবং শহরের ২৪ শতাংশ ও সিটি করপোরেশনের ১৫ শতাংশ মানুষ রয়েছেন।
সংস্থাটি বলছে, ২২ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সবচেয়ে বেশি ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ কৃষক পরিবারের সমস্যা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন অবস্থার জন্য অর্থনৈতিক সংকট এবং লাগামহীন বাজার ব্যবস্থাকেই দায়ী। এই অবস্থায় তাল সামলানোর বেশি চাপে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
বিআইআইসিসির গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর বলেন, অর্থনৈতিক চাপ ও মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। এ সময়ে কর্মসংস্থান হলেও তা গুণগত নয়। ফলে পর্যাপ্ত আয়-উপার্জন না থাকায় মানুষ ঋণ করছেন।
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি কতটা ভঙ্গুর। প্রয়োজন মেটাতে ঋণ করে চলছেন অনেকে। যারা দরিদ্রসীমার ওপরে আছেন, তাদেরও যে আয় বেশি সেটা কিন্তু নয়। তারাও আরামদায়ক পরিস্থিতিতে নেই।
এটা বাংলাদেশের জন্য রেড অ্যালার্ম জানিয়ে বিআইআইসিসির গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর বলেন, যদি দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থায় থাকেন, তবে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষগুলো জনসম্পদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন।
জরিপে উঠে এসেছে, গত ছয় মাসে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, পাশাপাশি পরিবারগুলোর পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া নিয়ে আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। দেশের আট বিভাগের ৩১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের অপর্যাপ্ত খাবার কিনতে হচ্ছে। এটি দীর্ঘদিনের জন্য উদ্বেগজনক চিত্র বলেও উঠে এসেছে জরিপে। ৪০ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবারে খাবারের তালিকায় নিম্নমানের খাবার ছিল।
ডব্লিউএফপি বলছে, বাংলাদেশে গত ছয় মাসে উচ্চ-পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবারের খাবারের প্লেটে এ সময় আয়রনসমৃদ্ধ খাবার ছিল, ৮১ শতাংশ পরিবারে মাঝেমধ্যে ছিল আর এ জরিপ শেষ হওয়ার আগের সাত দিনে ৬ শতাংশ পরিবারের এ ধরনের কোনো খাবারই ছিল না। নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর খাবারের প্লেটে পুষ্টিকর খাবার রাখার সামর্থ্য ছিল না।
জরিপের তথ্য বলছে, দেশের ৩১ শতাংশ মানুষ শুধু খাবারের ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন, জীবনযাপনের ব্যয়ে কৌশলী ৬৮ শতাংশ মানুষ। ২৫ শতাংশ মানুষ বলছে, স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছে। আবার পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং পারিবারিক ব্যয় বহন করতে গিয়ে ঋণ বেড়ে গেছে বলে অনেকে জানিয়েছে।