থার্টি ফার্স্ট নাইটে ফানুস ও আতশবাজি ফোটানোকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়াকড়ি অবস্থান নিলেও ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে কেনা-বেচা চলছে এই পণ্য। ঘরে বসেই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে ফানুস-আতশবাজি-পটকা। অর্ডার দিলেই নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যাচ্ছে পণ্য।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি ফোটানোকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। গতবছর থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনে ফানুস ওড়াতে গিয়ে রাজধানীর অন্তত ১০টি স্থানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। ঢাকার বাইরে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৯০টি। মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনও হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত।
ডিএমপি বলছে, ফানুস ওড়ানো অথবা আতশবাজি ফোটানো অবস্থায় কেউ যদি হাতেনাতে ধরা পড়ে তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসবকে তোয়াক্কা না করেই দেধারছে চলছে ফানুস ও আতশবাজি বিক্রি। প্রকাশ্য না হলেও পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গোপনে চলছে বেচা-বিক্রি। অনলাইনেও সহজলভ্য হচ্ছে এসব পণ্য।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আতশবাজির সবচেয়ে বড় মার্কেট পুরান ঢাকার চকবাজার, শাঁখারিবাজার ও তাতীবাজার বুড়িমার সেই বিখ্যাত আতশবাজির আঁতুড় ঘর এখানেই। আগের মতো আতশবাজি পাওয়া না গেলেও একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় রয়েছে এই বেচা বিক্রির সাথে।
ক্রেতাদের টার্গেট করে অন্ধকার গলিতে ডেকে নিয়ে চলে দামদর ।বনিবনা হলেই কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত পণ্য।
ডিএমপি সূত্র বলছে, কয়েক দিন ধরে রাজধানীর যেসব এলাকায় ফানুস ও আতশ বিক্রি হয় চকবাজার শাখারীবাজার সহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছে ডিএমপির বিভিন্ন থানা পুলিশ।
এসম্পর্কে লালবাগ বিভাগের চকবাজার জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) শফিকুর রহমান বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে থার্টি ফার্স্ট নাইট এবং নির্বাচনী সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফানুস ও আতশবাজিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই সম্পর্কে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলেও জানান তিনি।
অনলাইনে চলছে হোম ডেলিভারি
ঝামেলা এড়াতে অনেকেই আতশবাজি কিনতে ঝুঁকছেন অনলাইনে। হোম ডেলিভারির সুবিধা থাকায় নির্বিঘ্ন হচ্ছে কেনাকাটা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন গ্রুপ পেইজ এমনকি ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকেই দেয়া হচ্ছে বিক্রির পোস্ট। বিডি ফায়ার ওয়ার্ক, ফায়ার ওয়ার্ক রিটেইলার শপ,বাজিঘড়, ব্যবসায়ীক আইডিয়া নামে একটি গ্রুপসহ একাধিক পেইজ ও গ্রুপে চলছে আতশ বেচাকেনা। ফানুস বাংলাদেশ, ফানুশ ঘর সহ বিভিন্ন নামের ফেসবুক পেজে দেখা যায়, যে কোনো ফানুস ও আতশবাজি অনলাইনে হোম ডেলিভারিতে বিক্রি করছেন তারা।
সেখানে আতশবাজি ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ফানুশ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, তারাবাজি ১২০ টাকা , চকলেট বোম মিলছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দরে।
চিহ্নিত হচ্ছে পেইজ
বড়দিন ও থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে রাজধানীতে সব ধরনের আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির নির্দেশনা অনুযায়ী, ফানুস ও আতশবাজি বিক্রি কিংবা ওড়ানো বা ফোটানোর সময় হাতেনাতে ধরা পড়লেই নেয়া হবে ব্যবস্থা। অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি, পটকা ফোটানো ও মশাল মিছিল নিষিদ্ধ হয়েছে।
তবে অনলাইনে সহজে মিলছে এই পণ্য -এমন প্রশ্নে অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা বরাবরই এই ধরনের পণ্য বিক্রি নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট রয়েছি। বেশ কয়েকটি পেইজ চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।
উৎসবের নামে নানামুখী ক্ষতি
গেল বছর ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্ট আবারো এই বছর নতুন করে জন্ম দিয়েছে নানা আলোচনা সমালোচনার। ফেসবুকে পোস্ট করা লেখাটি হার্টে ছিদ্র নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মাত্র চার মাস বয়সী শিশু তানজিম উমায়ের পিতা ইউসুফ রায়হানের।
জন্মের সময় হার্টে কিছুটা সমস্যা ছিলো ছোট্ট উমায়েরের। বাবা-মা তাদের সর্বস্ব দিয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে নিচ্ছিলেন। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টা! থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের নামে শুরু হলো বিকট শব্দে আতশবাজি ফোটানো! আতশবাজির শব্দে কেঁপে উঠছিলো পুরো শহর, হার্ট কিছুটা দুর্বল থাকায় আতশবাজির শব্দে কেঁপে উঠছিলো ছোট্র উমায়ের। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলো বাবা-মা, তীব্র শব্দ দূষণে অসুস্থ হয়ে পরে উমায়ের। নেওয়া হয় হাসপাতালে, সেখানেই মারা যায় ছোট্ট উমায়ের।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, উমায়ের আগে থেকেই অসুস্থ ছিল। ওই ফেসবুক পোস্ট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বাবা ইউসুফ জানান, বর্ষবরণের রাতে আতশবাজির বিকট শব্দে ভয়ে তার ছেলেটি বারবার কেঁপে উঠছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। সকাল থেকেই শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় তার ছোট্ট উমায়ের।
এদিকে নেটিজেনরা বলছেন, প্রকৃতির নিয়ম মেনে প্রত্যেক বছরের মতো ২০২৩ বছরটা শেষ প্রায়। সামনে ৩১ শে ডিসেম্বর অর্থাৎ থার্টি ফার্স্ট নাইট অনেকেই এদিন আনন্দ উদযাপন করতে ফানুস, আতশবাজি ইত্যাদি ব্যবহার করেন। রাজধানীবাসীর প্রতি বিনীত অনুরোধ, নিজের একটু আনন্দের জন্য পরিবেশের ক্ষতি না করার আহবান তাদের।
ইংরেজী নববর্ষের ইতিহাস
আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর। তবে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ধারণাটি আসে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে। তখন মেসোপটেমিয় সভ্যতার (বর্তমান ইরাক) লোকেরা নতুন বছর উদযাপন শুরু করে। তারা তাদের নিজস্ব গণনা বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করতো। তবে রোমে নতুন বছর পালনের প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ সালে। পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত।
রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের অন্তর্গত বছরের প্রথম দিনটি জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। জানুস হলেন প্রবেশপথ বা সূচনার দেবতা। তার নাম অনুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম জানুয়ারি নামকরণ করা হয়। এতো গেলো যিশুর জন্মের আগের কথা। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে ১৫৮২ সালে পোেপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার করেন। যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়।
এদিকে ইংরেজি নতুন বর্ষ পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন ইসরায়েল, দেশটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। কারণ বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী অ-ইহুদি উৎস হতে উৎপন্ন এই রীতি পালনের বিরোধিতা করে থাকে। আবার কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণই করেনি। যেমন সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না।
বিভিন্ন দেশে নতুন বছরের প্রথম দিনটি পাবলিক হলিডে। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা এক মিনিট থেকেই শুরু হয় নতুন বছর উদযাপনের উন্মাদনা। আকাশে ছড়িয়ে পড়ে আতশবাজির আলোকছটা। বিশ্বব্যাপী নিউ ইয়ার ডে সর্বজনীন একটি উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে।
যেভাবে এলো থার্টি ফার্স্ট নাইট
থার্টি ফার্স্ট নাইট হল খ্রিস্টীয় বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাত। পহেলা জানুয়ারির প্রথম প্রহর। ৩১ ডিসেম্বর এই দিনে রাত ১২ টার পর থেকে সারাবিশ্বে শুরু হয়ে যায় উৎসবমুখর পরিবেশ। নতুন বছরকে বরণ করতে পালন করা হয় নানা ধরনের অনুষ্ঠান, আতশবাজি, নাচ ও ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশে এই দিনটিতে পাবলিক হলিডে পালন করা হয়। বিভিন্ন ধরনের উৎসব পালনের মাধ্যমে মুখরিত করা হয় এই দিনটি। নতুন বছরের প্রথম দিনটি পুরনো দিনগুলোর স্মরণার্থে এবং নতুন দিনগুলোকে আগমন জানতে পালন করা হয়। থার্টি ফার্স্ট নাইটকে নিউ ইয়ারও বলা হয়। তবে, কিছু মুসলমান রাষ্ট্রে এই দিনটি পালিত হয় না।
থার্টি ফার্স্ট নাইট ইংরেজি শব্দ। থার্টি অর্থ ত্রিশ। ফার্স্ট অর্থ প্রথম এবং নাইট অর্থ রাত। থার্টি ফার্স্ট নাইট অর্থ কি? অর্থাৎ থার্টি ফার্স্ট নাইট অর্থ একত্রিশ এর রাত। ইংরেজি নতুন বর্ষকে বরণ করার লক্ষ্যে এই দিবসটি পালন করা হয়।