এগ্রো খামারগুলোর মাধ্যমে গরুর দাম যেভাবে বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুন ১৭, ২০২৪, ০৭:০২ পিএম

এগ্রো খামারগুলোর মাধ্যমে গরুর দাম যেভাবে বাড়ছে

সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও থেকে। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ভারতের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে বাংলাদেশে। সেখানে একজন নারীকে প্রশ্ন করা হয় তার সামনে থাকা গরুটির দাম কত? জবাবে ওই নারী বললেন, মাত্র ১০ হাজার। রূপির দিক বিবেচেনা করলে বাংলাদেশে সেই গরুর দাম মাত্র ১৫ হাজার টাকা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি আপনি বিবেচনা করেন সেখানে কিন্তু গরুর দাম এখন নাগালের বাইরে। ঠিক কি কারণে গরুর দাম এত বেশি, কোন প্রক্রিয়ায় গরুর দাম বাড়ানো হচ্ছে, সেগুলো নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদনে থাকছে আয়োজন। চলুন জেনে আসি-

গৃহপালিত গরু নেই সব খামারে
এবারের কোরবানির গরু নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সম্ভবত সাদিক এগ্রোর বংশমর্যাদাপূর্ণ গরু। গত এপ্রিলে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাদিক এগ্রোর কর্ণাধার ইমরান হোসেন বংশমর্যাদাপূর্ণ ব্রাহমা জাতের গরুর দাম ১ কোটি টাকা হাঁকান। এই ধরনের তিনটি গরু ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায়ও বিক্রি করেন তিনি।

এখন প্রশ্ন থেকে যায় বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হবার পরও কেন গরুর দাম এত বেশি। সেই সঙ্গে ব্রাহমাসহ মাংসের যে ব্রিড সেগুলো আমাদনি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে বিক্রি হচ্ছে এই ধরনের গরু? এর আগে ২০২১ সালে বিমানবন্দরে ১৮ টি ব্রাহমা জাতের গরু জব্দ করা হয়েছিল।

প্রাণিসম্পদের সর্বশেষ হিসাব

প্রাণিসম্পদের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১ কোটি ৭০ হাজার পশু অর্থাৎ গরু-মহিষ-ছাগলের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এর উল্টোদিকে পশু আছে ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার পশু। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৯ লাখ পশু বেশি রয়েছে।

অর্থনীতির সাধারণ হিসাব অনুযায়ী কোনও পণ্যের চাহিদার তুলনায় যোগান বা সরবারহ বেশি হলে সেই পণ্যের দাম কমে। কিন্তু দেশে গরু ও ছাগলের উৎপাদন বেশি হলেও কেন দাম কমছে না। এর জবাবে আছে আঁতকে ওঠার মতো পরিসংখ্যান।

২০২৪ সালে কোরবানিযোগ্য গরুর সংখ্যা ৫৩ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। কিন্তু এই সব গরুই খামারে উৎপাদন করা হয়েছে অর্থাৎ গৃহপালিত গরুর সংখ্যা শূন্য। এদিকে ২০২৩ সালেও দেখা যায় একই চিত্র। সেই বছর ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার গরুর বিপরীতে গৃহপালিত গরুর সংখ্যা ছিল শূন্য। যদিও ৬০ লাখ ৪৬ হাজার ছাগল ও ভেড়ার বিপরীতে গৃহপালিত ছাগলের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৪৩ হাজার। অর্থাৎ আগে যে গৃহস্থের গরু পাওয়া যেত সেই অবস্থা এখন আর নেই। যেটি পুরোটাই বিভিন্ন এগ্রোর নামে খামারিরা দখলে নিয়েছে।

গৃহস্থের গরু ও খামারের গরুর দামের পার্থক্য

গৃহস্থের গরু ও খামারের গরুর দামের পার্থক্য
কোরবানির মৌসুমে দেশে চাহিদার ৬০ শতাংশ গরু, ছাগল ও অন্যান্য পশু বিক্রি হয়ে থাকে। অর্থাৎ ১ কোটি ৭০ লাখ চাহিদার বিপরীতে কোরবানির সময়ই ৬১ লাখ গরু ও ছাগল বিক্রি হবে। সারা বছর যে গরু-ছাগল বিক্রি হচ্ছে এসব পশুর যোগান দিচ্ছে গৃহপালিত গরু-ছাগলই। এগ্রো ও অন্যান্য খামারিরা তাদের গরু-ছাগল শুধু কোরবানির সময়ই বিক্রি করছেন।

এখন প্রশ্ন থেকে যায় গৃহস্তের গরু ও খামারের গরুর দামের পার্থক্য আছে কি? এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের মতে গ্রামে গরু ও অন্যান্য পশু পালনে মুনাফা হয় ৪-১২ শতাংশের মতো। অর্থাৎ লভ্যাংশ অনেক কমেই তারা গরু-ছাগল বিক্রি করে থাকেন।

এদিকে ইন্দোনেশিয়ার দিপনিগোর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে খামার পর্যায়ে এই গরু-ছাগলে লাভের পরিমান অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রতি ২ টাকা ব্যয়ে লাখ ১ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ করে থাকে খামারীরা। ফলে দেখা যাচ্ছে গৃহস্তের গরু যেখানে ৪ শতাংশ লাভ করছে খামারিরা করছে ৫০ শতাংশ লাভ। এই অতিরিক্ত মুনাফার কারণে বেড়ে যাচ্ছে গরুর দাম।

সাদিক এগ্রোর কর্ণাধার ইমরান হোসেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমাদের উন্নত মাংসের জাত আনার ব্যবস্থা করে দিলে গরুর মাংসের দাম কমাতে পারবো। সরকার সেই ব্যবস্থা না করে ব্রাজিল থেকে মাংস আমদানি এগুলো বিবেচনা করছে। কিন্তু ব্রাজিল কোন জাত লালনপালন করে যার ফলে তারা ৪০০-৫০০ টাকায় আমাদের গরুর মাংস দিতে পারে সেগুলো আমাদের দিলেই হয়।”

এদিকে গরুর মাংসের দাম বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে খামারিরা চারটি কারণকে দায়ী করেছেন:
১. গরুর খামার স্থান সংকুলান না হওয়া;
২. গরুর ফিডের দাম বেশি থাকা;
৩. শিল্প কারখানার রেটে বিদ্যুৎ বিল;
৪. মাংসের ব্রিড আমদানির সুযোগ কম থাকা।

প্রথমেই যদি গরুর খামার বা লালনপালনের জন্য স্থানের সংকুলানের বিষয়টি দেখি তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে গরুর মাংসের দাম কম সেখানে গরুগুলোকে চারণভূমিতে লালনপালন করা হয়। অর্থাৎ নিউজিল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে গরুর জন্য প্রচুর ঘাসের ব্যবস্থা থাকে। খামারের পাশাপাশি সেখানে উন্মুক্ত স্থানে তারা এই গরু লালনপালন করে থাকে। তবে বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি ভিন্ন। শুধু মোহাম্মদপুরেই দুই শতাধিক গরুর খামার গড়ে উঠেছে। যেগুলোর বেশির ভাগই অনুমোদনহীন। সাধারণত শহরতলী ও গ্রামে গরু পালনের কথা থাকলেও এতে লাভ বেশি হওয়ায় এখন শহরেই গরুর খামারগুলো উঠে এসেছে। এই খামারে ঘাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক খাবার কম থাকায় গরুর ফিডের মাধ্যমেই লালনপালন করা লাগছে।

কোরবানির গরু

যে প্রসঙ্গে আসে দ্বিতীয় কার গরুর ফিডের দাম। খামারে গরু লালন পালন ফিড নির্ভর হওয়ার কারনে দেশে চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে পারছে না ফিড নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে গরুর খামারে জনপ্রিয় ফিডগুলোর মধ্যে এসিআই গ্রুপের ফিড বেশি প্রচলিত। এসিআই মিট মোর, এসিআই এগ্রো ভেট এগুলোর দাম কেজি প্রতি ৪৪ টাকা থেকে ৫৮ টাকা। সেখানে একটি মাঝারি আকারের গরু দেশে ৩ থেকে ৪ কেজি ফিড খেয়ে থাকে। এদিকে পাশ্ববর্তী দেশ ভারেত  ফিডের দাম মাত্র ১২ রূপি থেকে অর্থাৎ ১৭ থেকে ১৮ টাকা। আর সেখানে গরুর গড়ে ১ কেজিরও কম ফিড খেয়ে থাকে। এদিকে খোলা স্থানে লালনপালন না করার ফলে দেখা দেখ আরেকটি সমস্যা। বিদ্যুৎ বিল।

গরু প্রচুর পরিমাণ গ্যাস নির্গত করে। ফলে খামারে গরমের পরিমাণ বেশি থাকে। যে কারণে খামারগুলোতে পানি ও ফ্যান নিয়মিত চালানো লাগছে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে গরুর খামার কৃষিজাত পণ্য হিসেবে নয় বরং শিল্পকারখানা হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে খামারে বিদ্যুৎ বিলের পেছনে খরচ অনেক বেড়ে যায়। গরু পোষার খরচও বেশি হয়ে যায়।

কোনও স্পেশাল ব্রিড না থাকা
বাংলাদেশে গরু পালনের ক্ষেত্রে দুগ্ধ উৎপাদনে জোর বেশি দেয়া হয়। ফলে বেলজিয়ান ব্লু, ব্রাহমা, এনগাসসহ বিভিন্ন মাংস উৎপাদনকারী জাত আমদানির সুযোগ নেই। কিন্তু বিভিন্ন গরমিল দেখিয়ে খামারগুলো ব্রাহমাজাত আমদানি করে থাকে। এদিকে ছাগলের ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত ব্লাক বেঙ্গল ছাগল ২০-২৫ কেটি ওজন হয়। সেখানে আফ্রিকান জাত বোয়ার, কালাহারি ভারতের তোতাপুরি, যমুনাপারি খাসির ওজন ৫০-৬০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এই ধরনের ব্রিড বা জাত না থাকার কারনেও মাংসের দামে প্রভাব রাখে।

এদিকে ২০১৯ সাল থেকে মাঝারি আকারের গরুর দাম আকস্মিক বাড়ানোর ক্ষেত্রে অভিনব এক পদ্ধতি চালু হয়েছে। প্রত্যেক খামারেই তখন থেকে লাইভ ওয়েটে গরুর বিক্রি করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। কেজিপ্রতি ৬০০-৭০০ টাকায় এই লাইভ ওয়েটে গরু বিক্রির ফলে মাঝারি আকারের গরুগুলো ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায়।

Link copied!