ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩, ০৮:২৯ এএম
আইন ও কোন পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা না থাকায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে দেশের ব্যাংকগুলো। নীতিমালা না থাকায় ব্যাংকগুলো শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে অনেক সুযোগ নিচ্ছে বলে জানায় অর্থনীতিবিদরা।
দেশে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে আমানত ও ঋণের হিসাবে দেখা গেছে, এক-চতুর্থাংশই ইসলামী ব্যাংকগুলোর দখলে। এখন পুরোদমে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে ১০টি ব্যাংক। দেশে ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার কোনো আইন এবং পূর্ণাঙ্গ কোনো নীতিমালাও না থাকায় এটা নিয়ে কথা হচ্ছে।
তারল্যসংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংককে লেনদেন থেকে বিরত রাখার বিষয়ে চিঠি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের নিয়মিত কাজ বলে জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি। তবে লেনদেন থেকে বিরত রাখার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সংকটে থাকা পাঁচ ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। সব কটি ব্যাংকই চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন।
সকল সূচকে পিছিয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং
অর্থনীতিবিদদের মতে কোন নির্দিষ্ট আইন কিংবা পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা না থাকার কারনে পরিচালনা পর্ষদ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সুবিধা নিচ্ছে। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য গত বছরের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত, অর্থাৎ এক বছরে কমেছে ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ বা ৯৮২ কোটি টাকা। অতিরিক্ত তারল্য কমার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও একই রকম তথ্য রয়েছে।
শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি তারল্যসংকটের চ্যালেঞ্জ হিসাব করা হয় লিকুইডিটি কভারেজ রেশিও বা এলসিআর কমে যাওয়ার হিসাব ধরে। ২০২২ সালের শেষ ছয় মাসে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর এলসিআর কমে দাঁড়ায় ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০২১ সালের শেষে এই হার ছিল ১৮৮ দশমিক ৮।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, দেশের ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানতের অনুপাত চলতি বছরের জুন মাসে ১০১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৪ শতাংশ। ঋণ-আমানতের অনুপাত এত বেশি হওয়ার অর্থ হলো, তারল্যসংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
দেশের ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি এসব ব্যাংকে তারল্য-ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও সরকারের কোনো ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল টুলস নেই। এ কারণে এসএলআর সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে নীতিছাড় দেয়া হয়েছিল। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও অন্য ব্যাংকের চেয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংক বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত।
২০২২ সালে দেশের ১০টি ইসলামি ধারার ব্যাংক আইন অনুসারে তারল্য বজায় রাখতে পেরেছিল; কিন্তু ছয় মাস পর দেখা যাচ্ছে, ১০টির মধ্যে ৪টি ব্যাংক এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। ৬টি ব্যাংক বিধি অনুসারে তারল্য বজায় রাখতে পারলেও তাদের অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল কম।
ইসলামী ব্যাংকিংয়ে আগ্রহী সবাই
দেশে শরিয়াহ ধারার ব্যাংক রয়েছে ১০টি। এগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে ছয়টি ব্যাংকেরই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এস আলম গ্রুপের হাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, এসব ব্যাংকে নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এর কারণে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে ভুগছে।
সম্পদের পরিমাণ বিবেচনায় বাংলাদেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের বাজারের আকার বিশ্বে অষ্টম। এসব ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭ কোটি টাকা।
আইন ছাড়াই বড় হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পরিধি
বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০৯ সালের গাইডলাইনের মাধ্যমে। এ ছাড়া প্রতিটি ইসলামী ব্যাংক ক্ষমতাসম্পন্ন শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ব্যাংকগুলোর সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ডও বিষয়গুলো দেখাশোনা করে। তা সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পূর্ণাঙ্গ আইনি কাঠামো থাকলে এর নিয়ন্ত্রণ আরো সহজ হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও সিইও মোসলেহ উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা আরও বিস্তারের সুযোগ আছে। কারণ বাংলাদেশ গত তিন দশকে ৬ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এখানে ইসলামী অর্থব্যবস্থার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকিং দেশে ও বিদেশে আরো টেকসই পরিচালনার জন্য স্বল্পমেয়াদি অর্থবাজারের সমর্থনের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট ইসলামিক ব্যাংকিং আইন প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৪ থেকে ১৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক পুরোপুরি ইসলামী ব্যাংকিং করতে চায়।প্রচলিত আইনেই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিষয়ে বলা আছে। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকিং করতে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য একটি গাইডলাইন আছে। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাংক চলছে কি না তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং ব্যবস্থাও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আসলে ইসলামী ব্যাংকিং হলো কাগজে-কলমে।
তবে নতুন নীতিমালা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, ইসলামি আইনশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিয়ে শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি গঠন করতে হবে। কোনো ব্যাংকের ব্যাংকার ও পরিচালকের এ ধরনের জ্ঞান থাকলেও বোর্ডের পদে থাকতে পারবেন না। তবে সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
ইসলামী ব্যাংক চালু হওয়ার এক বছর আগে ‘ইসলামী ব্যাংকিং আইন’ চালু করেছিল থাইল্যান্ড। অথচ বাংলাদেশে ৪০ বছর ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে এলেও এখন পর্যন্ত এসংক্রান্ত আইন চালু করা যায়নি। ২০১১ সালে অর্থবিষয়ক স্থায়ী কমিটির কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি খসড়া আইন চূড়ান্ত করে জমা দিয়েছিল। কিন্তু এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।
ইসলামী ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকের একটি শরিয়াহ বোর্ড আছে। আলাদাভাবে আইন করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং শরিয়াহ বোর্ডের ভূমিকা কী হবে—এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং চালু হয়। আরো অনেক ব্যাংক বিশেষায়িত শাখা ও উইন্ডো খোলার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এ ছাড়া অন্য অনেক প্রচলিত ব্যাংকও এখন ইসলামী ধারার সেবা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।