এক সময় বাংলাদেশের সেরা ব্যাংক হিসেবে পরিগণিত হতো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। স্বল্পমাত্রায় মন্দ ঋণ, ব্যাংকিং বিধিবিধান পরিপালন, পর্যাপ্ত তারল্য ও গ্রাহকের গ্রাহকের অগাধ আস্থা অর্জন- সবকিছু নিয়েই ব্যাংকিং কার্যক্রমের অসামান্য পারফর্মেন্সের ট্র্যাক রেকর্ড ছিল।
এই ব্যাংকের মাধ্যমেই ২০১৫ সালে দেশের মোট প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের ২৭ শতাংশ এসেছিল।
অথচ ইসলামী ব্যাংকের আজকের চিত্র আগের তুলনায় একেবারেই উল্টো। যে ব্যাংকের কাছে একসময় বিপুল তারল্য বা নগদ অর্থ ছিল- এখন সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের বিধান পূরণেই হিমশিম খাচ্ছে। এ ছাড়া এই ব্যাংককে জরুরি তহবিলের জন্য হাত পাততে হচ্ছে সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেই।
ব্যাংক খাতের একসময়কার এই জায়ান্টের এমন দুর্দশা হলো কীভাবে সেটা নিয়ে আজ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের পাঠকদের জন্য এই আয়োজন-
বহু বছর ধরেই ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ছক কষা হয়েছিল। ২০১৩ সালে এসে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়।
এই সময়ে এসে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় অর্থায়নের প্রচারণা চালানো হয়। এ-অবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তদানীন্তন চেয়ারম্যান- ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে কথিত সন্ত্রাসবাদের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখার জন্য ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আহ্বান জানান।
অপপ্রচারের এই আগুনে ঘি ঢালেন ২০০৯ থেকে ২০১৪ সময়কালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। ২০১৩ সালে এক বৈঠকের পর তিনি দাবি করে বসেন, ইসলামী ব্যাংকের ৮ শতাংশ অর্থায়নই সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট।
তার সেই মন্তব্য ব্যাংক-খাতকে সমূলে আন্দোলিত করে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নর আতিউর রহমান প্রধান প্রধান বিদেশি ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক জরুরি সভায় প্রতিমন্ত্রীর কথায় কর্ণপাত না করে সবাইকে আইবিবিএলের সঙ্গে তাদের ব্যবসা চালু রাখার অনুরোধ করেন।
সেই সময় ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) ছিলেন মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান।
চাপের মুখে তিনি টুকুর বাসভবনে যান। প্রতিমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন “স্যার, আপনি এটা কীভাবে বলতে পারলেন? আপনার মন্তব্য সার্বিকভাবে আমাদের ব্যবসা বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল অপারেশনের (আন্তর্জাতিক কার্যক্রম) জন্য মারাত্মক।”
এই কথায় টুকুর নির্বিকার উত্তর ছিল: “মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
ইসলামী ব্যাংক দখলে নেওয়ার নতুন চেষ্টা
৫ জানুয়ারি ২০১৪
আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতা পায়। এই সময়ই ইসলামী ব্যাংক দখলে নেওয়ার চেষ্টা নতুন মাত্রা পেতে থাকে। এই পর্যায়ে ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের সামনে এগোনোর রাস্তা খুলে যেতে থাকে।
২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যাংকটিতে অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা দেয়। সেই সময়কার আর্থিক অবনতির কথা স্মরণ করে ইসলামী ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “তখনও দৃশ্যপটে এস আলম গ্রুপ ছিল না। প্রথমে পরিকল্পনা করা হয়, রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ও পেশাদার ৩-৪ জন স্বাধীন পরিচালককে নিয়োগ দেওয়া হবে।”
তবে ২০১৫ সালে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে দেশের অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানান তিনি।
২০১৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইসলামী ব্যাংকের স্বাধীন ৪ পরিচালক নিয়োগের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন- ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আজিজুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী হেলাল আহমেদ চৌধুরী এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল। এই পরিচালকদের একজন– ব্যাংকের অডিট বা নিরীক্ষার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে শত শত আপত্তি তুলতে থাকেন, এর মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাংকটি দখলের ভিত্তি।
এরপর দ্রুতই সব পরিবর্তন ঘটানো হয়। ২০১৬ সালে শুধু কাগজে-কলমে অস্তিত্ব আছে- এমন নতুন নিবন্ধিত কিছু কোম্পানির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কেনা শুরু করে এস আলম গ্রুপ। এর ফলে ব্যাংকের ভেতরে তাদের প্রভাব বিস্তারের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালকের নিয়োগের ক্ষমতা সুসংহত করতে থাকে তারা।
তখন ব্যাংকের আরেক জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, জীবনে যেসব কোম্পানির নামই শুনিনি- তারা প্রত্যেকে শত কোটি টাকার বেশি শেয়ার কিনেছিল। অথচ এরা কারা? তারা কীসের ব্যবসা করে? কোথা থেকে এত টাকাকড়ি পেল?- সেটা জানতে কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদন্তের কথাও ভাবেনি।
ইসলামী ব্যাংকে ৫ জানুয়ারির ক্যু
ব্যাংকটির সামনে আরও প্রতিকূল সময় আসছে এমনটা অনুধাবন করে ইসলামী ব্যাংকের স্পন্সরদেরও অনেকে তাদের শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন। পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে নেওয়ার পরে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগ শেয়ার চলে আসে এস আলমের হাতে। ফলে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য ক্রীড়নক। এরপর গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ক্ষমতা ও রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এই দখলের নৈরাজ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশ হয়েছিল।
ইসলামী ব্যাংক যেভাবে হয়ে উঠল এস আলম গ্রুপের নিজস্ব ঋণের যন্ত্র
২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগেই ব্যাংকটির চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক ছিল এস আলম গ্রুপ। তাদের ঋণ ছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ইসলামী ব্যাংক থেকে এই শিল্পগোষ্ঠীর নেওয়া ঋণ আকাশচুম্বী হতে থাকে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের জুন থেকে বাজার থেকে শেয়ার কিনে ব্যাংকটির মালিকানায় চলে আসে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির প্রায় অধিকাংশ শেয়ার কিনে নেয় তারা। এরপর দেশি-বিদেশি অনেক কোম্পানি ও ব্যক্তি শেয়ার ছেড়ে দিতে শুরু করেন।
ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে হামলা, নিহত ৬
রোববার মতিঝিলের দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টায় কর্মকর্তাদের ওপর হামলা, সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শফিউল্লাহ সরদার, আবদুল্লাহ আল মামুন, আব্দুর রহমান ও বাকিবিল্লাহসহ ৬ জন নিহত হন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পরদিন এস আলম গ্রুপের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের বের করে দেন বিক্ষুব্ধ ব্যাংকাররা। এরপর ৭ ও ৮ আগস্ট ব্যাংকারদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।
ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় বিপুল অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারির প্রতিবাদ জানাতে রোববার সকাল সোয়া ১০টার দিকে তারা ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন।