জানুয়ারি ৩১, ২০২৪, ০৩:৫৩ এএম
৯০ এর দশকে, পণ্য প্রচারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসাবে কোম্পানিগুলো রেডিও এবং টেলিভিশনে খুব আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করত। আপনি যদি সেইসব বিজ্ঞাপনের তালিকা করেন, দেখবেন কেয়ার বিজ্ঞাপনগুলো পুরোপুরি আলাদা।
নারকেল তেল, বিউটি সোপ, লিপ জেল, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনীর চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন প্রচার করা কেয়াকোম্পানি ১৫ শতাংশের বেশি বাজার শেয়ার দখল করেছিল। ব্যাপক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন টেলিভিশন শো ‘ইত্যাদি’র স্পন্সরশিপের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে কেয়া কসমেটিকস পণ্যের বিজ্ঞাপন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। মানুষ কেয়ার পণ্য কিনছেও না। বহুল জনপ্রিয় এই কোম্পানির হঠাৎ কেন পতন হলো?
এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে বাংলাদেশে কেয়া কসমেটিক্সের যাত্রা কীভাবে শুরু হলো সে সম্পর্কে জেনে নেয়া জরুরী।
কেয়া গ্রুপের উত্থান
একদম শুরুতে কেয়ার প্রধান পণ্যটি ছিল সাবান। পরবর্তীতে আরও সাবানের আরও কয়েকটি রং এবং সুগন্ধ যোগ হয়। এর মধ্যে যোগ হয়েছিল কেয়া লেমন বিউটি সোপ, ফেয়ারনেস বিউটি সোপ, স্কিনকেয়ার বিউটি সোপ, হারবাল বিউটি সোপ, বেবি সোপ, বল সোপ, লাইফগার্ড সোপ ইত্যাদি। কোম্পানিটি পরবর্তীতে পেট্রোলিয়াম জেলি, লিপ জেল, ডিটারজেন্ট পাউডার, শেভিং ক্রিম, শ্যাম্পু ইত্যাদি উৎপাদন শুরু করে। কোম্পানির পণ্যের প্রধান কাঁচামাল হল সোডিয়াম লবণ, পাম তেল, এবং পরিশোধিত, ব্লিচড এবং ডিওডোরাইজড বা আরবিডি কোকো তেল। এই কাঁচামাল মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে আমদানি করা হয়। কেয়া সুইস কোম্পানি ক্ল্যারিয়ান্ট এবং জার্মান কোম্পানি বিএএসএফ থেকে রঙের সামগ্রীও আমদানি করে। অন্যদিকে কেয়া পণ্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়।
কেয়া লেমন বিউটি সাবান কেয়ার সবচেয়ে সফল ব্র্যান্ড হিসাবে বিবেচিত হয় এবং কেয়া সুপার বিউটি সোপের ঠিক পিছনে রয়েছে এর অবস্থান। কোম্পানিটি একবার তিনটি সুগন্ধি এবং ভিটামিন ই সমৃদ্ধ বিউটি সাবান তৈরি করে বিউটি বার সোপ ক্যাটাগরিতে বাজারে অন্যান্য ব্র্যান্ডের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। কেয়া পরে এই সুপার বিউটি সোপের একটি মিনি সংস্করণ চালু করেন। কেয়া পরে বল সাবান এবং গ্লিসারিন লন্ড্রি সাবান তৈরি করে লন্ড্রি সাবানের বাজারে প্রবেশ করেন। হারবাল বিউটি সোপ এবং স্কিন কেয়ার সোপ উৎপাদনের মাধ্যমে কোম্পানিটি ধীরে ধীরে প্রায় সব বিভাগেই প্রবেশ করেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে কেয়া বল সাবানের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কেয়ার পতনের কারণ:
‘কেন্দ্রবিন্দু’ থেকে সরে আসা
প্রসাধনী ব্যবসায় স্থিতিশীলতা এবং দৃঢ় অবস্থান পাওয়ার আগে গার্মেন্টস ব্যবসার মতো মূলধনকেন্দ্রিক ব্যবসার দিকে ঝোঁকের কারণে কোম্পানিটি মূল ব্যবসা থেকে তার মনোযোগ সরিয়ে নেয়। ফলে কসমেটিকস ব্যবসায় অবনতি হতে থাকে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে প্রসাধনী খাতে কোম্পানির বাজারের অংশ ৫ শতাংশ ছিল। ২০-১২-১৩ অর্থবছরে, যেখানে কেয়ার স্থানীয় বিক্রি ছিল ২৬০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা প্রায় অর্ধেক কমে ১৪০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। প্রসাধনী পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা প্রসাধনী ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য কোনো কার্যক্রম দেখায়নি। টিবিএসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিক সংকটের কারণে দুটি উৎপাদন ইউনিটে সীমিত আকারে ডিটারজেন্ট ও সাবান উৎপাদন হচ্ছে।
একটি দুর্দশাগ্রস্ত কোম্পানি হয়ে উঠেছে
২০০০ এর দশকে দেশের পোশাক শিল্প যেমন বেড়েছে, তেমনি পণ্যটির চাহিদাও বেড়েছে। কেয়া এই সুযোগটি নিতে চেয়েছিল এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি কারখানা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিল। এসব কারখানা নির্মাণ ও অন্যান্য বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটি অনেক ঋণ নিয়েছে। বিশ্ববাজারে তুলার দামের অস্থিরতার কারণে কোম্পানিটি ২০১০ সালেও বেশি দামে তুলা কিনেছিল। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে এবং সে অনুযায়ী বিক্রি করতে না পারায় আশানুরূপ মুনাফা করা সম্ভব হয়নি। তার ওপর ২০১০-১১ সালে কোম্পানিটির প্রায় ৫০০ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ বাতিল করা হয়। এরপর থেকে নিয়মিত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবসায়িক ইউনিটগুলো একীভূত করা, পুঁজিবাজারে শেয়ার ইস্যুসহ নানা বিষয়ে শেষ রক্ষা হয়নি। ২০১২ সালে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার নাম বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপির তালিকায় চলে যায়। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ বার্ষিক প্রতিবেদনে, কেয়া কসমেটিক্সের প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ বকেয়া ছিল। ২৩ জুন ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত শীর্ষ ৩০০ ঋণ খেলাপির তালিকায়, কেয়া কোম্পানি পুঁজিবাজারের শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে ছিল এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ঋণ পরিশোধ তুলনামূলক স্বাভাবিক বলে বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
ক্যাটাগরিতে বৈচিত্র্যতার অভাব
গত এক দশকে কেয়া তাদের পণ্য নিয়ে কোনো কাজ করেননি। তাদের পণ্যের ক্যাটাগরি আগের মতোই রয়েছে এবং সেসব ক্যাটাগরিতে আগের পণ্যগুলো সীমিত পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে। সাবান, ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু এখনও বিক্রি হচ্ছে। কোন বয়স-ভিত্তিক বা লিঙ্গ-ভিত্তিক বিভাগ তৈরি করা হয়নি। অন্যদিকে, বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি এবং প্রসাধনী ব্র্যান্ডগুলি ইউনিসেক্স পণ্যের অবস্থান এবং তাদের বাজারের অংশীদারিত্ব বাড়াতে পুরুষ ও মহিলা-কেন্দ্রিক পণ্য তৈরি করছে।
বিপণন ও বিজ্ঞাপন কম
একটি কোম্পানির ভয়েস শেয়ার হল কোম্পানির যে সেক্টরে ব্যবসা করছে তার মোট বিজ্ঞাপন এবং বিপণন কার্যক্রম। পণ্য বিপণন এবং প্রচারমূলক কার্যক্রম গত পাঁচ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।মিডিয়া মার্কেটিং প্রচারের একটি বড় অংশ দখল করে। সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্টও সোশ্যাল মিডিয়ার উপর অনেক বেশি নির্ভর করে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ইভেন্ট স্পন্সরশিপের মাধ্যমে পণ্যের প্রচার হয়। সব মিলিয়ে কোম্পানিগুলো এক বা দুটি মাধ্যমের ওপর নির্ভর না করে বিস্তৃতভাবে মার্কেটিং কৌশল অনুসরণ করছে। যেমন : লাক্স বিভিন্ন নাটক সিরিয়ালের টাইটেল স্পন্সরশিপ, লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টারের স্পন্সরশিপ, বিলবোর্ড মার্কেটিং, সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে পণ্যের প্রচার করে।
কেয়া এই দিক থেকে ব্যতিক্রম। কেয়া এখনও ম্যাগাজিন শো ইত্যাদির স্পন্সর হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইত্যাদি এখন কোথায় আছে তা আমরা সবাই জানি।
দুর্বল পণ্য বিতরণ
কেয়া পণ্য বিতরণের ঐতিহ্যগত মডেল অনুসরণ করে আসছে। এবং তা হল – প্রস্তুতকারক থেকে পাইকারী বিক্রেতা থেকে খুচরা বিক্রেতা এবং অবশেষে ভোক্তাদের কাছে। এর মানে হল যে, অন্যান্য প্রসাধনী সংস্থাগুলির মতো কেয়াও তার মধ্যস্থতাকারীদের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে। চাহিদা অনুযায়ী অপর্যাপ্ত পণ্য পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতারা কেয়ার পণ্যের প্রতি কম আগ্রহী। অন্যান্য কোম্পানিগুলি তাদের পাইকারী বিক্রেতা এবং খুচরা বিক্রেতাদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা প্রদান করে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখে। এ ক্ষেত্রে কেয়া বেশ কয়েক বছর ধরে বেশ উদাসীন।
শেয়ার মার্কেটে কেয়া কসমেটিকস
শেয়ারবাজারে কেয়ার অবস্থান সন্তোষজনক নয়। কোম্পানিটি ২০১০ সাল থেকে কোনো নগদ লভ্যাংশ দেয়নি।
২০১১ সালে, কেয়া তার ঋণ পরিশোধের জন্য একটি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১০০কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল। ঋণ পরিশোধের জন্য মালিক বিভিন্ন সময়ে শেয়ারও বিক্রি করেছেন। কোম্পানির পৃষ্ঠপোষক পরিচালকদের শেয়ারহোল্ডিং এই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৬ শতাংশ ছিল, যা ২০১৭ সালেও ছিল ৬৩ শতাংশ।
করোনাভাইরাসের কারণে যেখানে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো প্রচুর মুনাফা লাভ করলো সেখানে কেয়া একেবারেই ব্যতিক্রম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পরে কোম্পানির কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি, কোনো ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। গত দুই বছর এজিএম বন্ধ থাকার পর অক্টোবরে কোম্পানিটির ২২তম এজিএম অনুষ্ঠিত হয়। ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি), বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বর্তমানে কেয়া রাজস্ব এবং মুনাফা রিপোর্টিং তদন্ত করছে।
পণ্যের গুণমান, মূল্য এবং জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে কেয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাজারে ভালো অবস্থানে যেতে পেরেছিল। কিন্তু ভুল কৌশল, পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাব এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে অনিয়মের কারণে কোম্পানিটি তার অবস্থান হারিয়েছে। কেয়া কসমেটিকস যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং অন্যান্য ব্র্যান্ডের কৌশলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেকে আপডেট করতে পারত তাহলে অন্যান্য নামী ব্র্যান্ডের সাথে কেয়াও সহাবস্থানে থাকত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।