দেশে আমানতের সুদহার এখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ২, ২০২১, ১২:৫৬ পিএম

দেশে আমানতের সুদহার এখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন

বিনিয়োগ খরায় ব্যাংকগুলোতে অলস তারল্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে গ্রাহকদের আমানতের সুদহার কমিয়ে দিয়েছে বেসরকারি সকল ব্যাংক। দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে এই সুদহার। মহামারীর আগে যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ৬-৯ শতাংশ সুদ দিত, তারাই এখন সুদহার দেড় শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তবে মেয়াদী আমানতের সুদহার কমায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

গড় সুদহার ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, জুন শেষে আমানতের গড় সুদহার ৪ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে গেছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। যেখানে মূল্যস্ফীতির হার (পয়েন্ট টু পয়েন্ট) গত এপ্রিলে ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতেই মূলত আমানতের সুদহার কমিয়ে দিচ্ছে। অন্য দিকে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমছে সে পরিমাণ সুদও পাচ্ছেন না আমানতকারী। এতে লোকসানে পড়ছেন তারা। এর ওপরে এক্সসাইজ ডিউটি (আবগারি শুল্ক) ও অন্যান্য চার্জের খড়গ তো আছেই। এমনি পরিস্থিতিতে সাধারণ গ্রাহকের আমানত পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

মূল্যস্ফীতি থেকেও নিচে সুদহার

আমানতের সুদের হার শুধু নিচে নেমেছে তাই নয়, মূল্যস্ফীতির থেকেও নিচে নেমে গেছে। যার ফলে ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে ঘরে রাখলে বছর শেষে বেশি লাভ পাবে গ্রাহকরা। যা খুবই বিপজ্জনক বলে জানায় অর্থনীতিবিদরা।। এতে আমানতকারীরা ব্যাংকের আমানত রাখার ক্ষেত্রে বিমুখ হবেন। যা ব্যাংকিং খাতের জন্য ভালো নয়।

অলস অর্থ ৬২ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংকগুলোর হাতে গত জুন শেষে অলস অর্থ রয়েছে (আমানতের বিপরীতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার বা সিআরআর অতিরিক্ত) ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এত সমস্যার পরও ব্যাংকগুলোকে বছর শেষে মুনাফা অর্জন করতে হবে। ব্যাংকের যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যত বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারে সেই এমডি ভালো হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে সবকিছু মেনে নিয়ে বছর শেষে মুনাফা অর্জনই ব্যাংকগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকছে। এতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেদিকে খেয়াল করছে না ব্যাংকগুলো। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে হারে আমানতের সুদহার কমছে তাতে আমানতকারীদের অবস্থা খারাপ হবে। তারা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারাতে পারেন। অর্থনীতির স্বার্থেই এটা ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ছে

পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন হয়েছে গত তিন মাসে। চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ১৯ জুলাই ডিএসইর বাজার মূলধন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এ তিন মাসে বাজার মূলধন বেড়েছে ৭০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা।

বাড়ছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ
বাড়ছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ

গত ১৯ এপ্রিল ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৩৪৯ পয়েন্ট। গত তিন মাসে ডিএসইএক্সে ১ হাজার ৫৬ পয়েন্ট যুক্ত হয়েছে। ১৯ জুলাই ডিএসইএক্সের সূচক দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪০৫ পয়েন্টে। তবে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানের সময় দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে সবচেয়ে বেশি রিটার্ন এসেছে।

তবে সাধারণ গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজিবাজারের এমন অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো ব্যয় কমাতে আমানতের সুদহার কমিয়ে দিচ্ছে। এতে আমানতকারীরা নিরুপায় হয়ে ব্যাংক থেকে বিমুখ হতে পারে। তাদের কষ্টার্জিত আমানত পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন। ফলে অনেকেই পুঁজি হারাবেন। এটা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।

ঋণ আদায়ে ভাটা

প্রসঙ্গত, করোনার প্রভাবে গত প্রায় দেড় বছর যাবৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলের কারণে ব্যাংকগুলোতে ঋণ আদায় ভাটা পড়ে গেছে। নীতিমালায় বলা হয়েছিল, কোন গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলে তাকে খেলাপি করা যাবে না। এ সুযোগ গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ছিল। কিন্তু ঋণ আদায় পরিস্থিতি তেমন কোন উন্নতি হচ্ছে না। আবার করোনার প্রভাবে ব্যাংকগুলো নতুন কোন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যেটুকু বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার বেশির ভাগই বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের মধ্যে চলতি মূলধনের জোগান দেয়া হচ্ছে। এতে অলস অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবেই আমানতের সুদহার কমিয়ে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

Link copied!