ডিসেম্বর ১, ২০২২, ০১:২৭ এএম
ভুয়া ঠিকানা ও নথিপত্রে কাগুজে কোম্পানির নামে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া এবং একই ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়াসহ নানা বিষয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে কথা বলেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। দ্য রিপোর্ট এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ: নভেম্বরে নাবিল গ্রুপকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, এত ঋণ কেন? আবাসিক ভবনে ঠিকানা দিয়ে ঋণ পাওয়া সম্ভব কীভাবে? পত্রিকায় রিপোর্টে এসেছে, ওই প্রতিষ্ঠানের বিল্ডিংয়ের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, নাবিল গ্রুপ নামে কোন প্রতিষ্ঠান সেখানে আছে কিনা।
মুনিরুল মওলা: নাবিল গ্রুপ ২০০২ সাল থেকেই আমাদের ক্লায়েন্ট। এই সময়ে নানাভাবে তাদের সাথে বিনিয়োগ হয়েছে। ২০ বছরের ইতিহাসে তাঁদের কোন ডিফল্ট নেই। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি কিছু ট্রেডিং ব্যবসায় এসেছে। এজন্য আমরাও কিছু বিনিয়োগ করেছি। সেই টাকাগুলো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণেরই আছে।
আর দারোয়ানের পক্ষে তো প্রতিষ্ঠানের নাম বলা সম্ভব না-ও হতে পারে। এটা বলা তো সম্ভর নয়। আমরা এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছি। সেখানে বলেছি, ওই বিল্ডিংয়ে প্রতিষ্ঠানটি আছে এবং ট্রেড লাইসেন্সও আছে।
দ্য রিপোর্ট: আবাসিক ভবনে ঠিকানা দিয়েও ঋণ পায় কীভাবে? আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, সিআইবি রিপোর্ট ছাড়াই লোন দেওয়া হয়েছে।
মুনিরুল মওলা: এই রিপোর্টগুলো উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। আমি বলছি, সিআইবি রিপোর্ট ছাড়া লোন স্যাংশন করার কোন উপায় নেই।
এস আলম বাংলাদেশের নামিদামি গ্রুপ। তাঁদের সাথে ইসলামি ব্যাংকের লেনদেন সম্পর্ক খুবই ভালো। কখনই হিসাব ওভারডিউ হয় নাই। প্রতিবছর ডিউ এডজাস্ট করে ফেলেন তাঁরা।
এক্ষেত্রে বলতে পারি, আমরা ব্যাংকের সব নিয়ম মেনেই বিনিয়োগ করেছি। তবে কিছু নিউজ অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা একটা ব্যাখ্যাও প্রস্তুত করছি।
দ্য রিপোর্ট: আপনি কি মনে করেন, কয়েকটি গ্রুপকে এত ঋণ দেওয়ায় ব্যাংকে প্রভাব পড়তে পারে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কি কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে?
মুনিরুল মওলা: ইসলামী ব্যাংক কোটি কোটি মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। আমাদের সর্বমোট লোনের পরিমাণ ১ লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। সারাদেশে প্রচুর গ্রাহক আমাদের। ফলে আমরা তা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি। এস আলম গ্রুপের লোন রিজেনেবল। তাঁদের লোন দিয়ে ব্যাংক অসুবিধায় পড়েছে— ব্যাপারটা এমন নয়।
আমাদের এক্স চেয়ারম্যান গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। আপনারা জানেন গার্মেন্টস ব্যবসার অবস্থা এখন ভালো নয়। এ অবস্থায় তিনি কিছু শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য। শেয়ার ছাড়তে গেলেও কিছু নিয়ম মানতে হয়। উনি সব নিয়ম মেনেই শেয়ার ছেড়েছেন। সম্প্রতি রিপোর্টগুলোতে এ ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয়েছে যেগুলোর সাথে এস আলম গ্রুপের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এগুলো তো কোর্টে যাওয়ার বিষয় না। আমাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যাংক আছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ আছে। ওনারা বিষয়গুলো জানতে চাইলে আমরা অবশ্যই জানাব।
আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ইতিমধ্যে বিষয়গুলো জানিয়েছি। এছাড়া আমাদের ক্লায়েন্টদের বিশ্বাস যাতে ভঙ্গ না হয় এজন্য কাজ করছি। দেশে আমরাই সবচেয়ে নিরাপদ ব্যাংক হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জন করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ‘টপ মোস্ট সাস্টেন্যাবল’ ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের প্রথমাংশে বলা হয়, ব্যাংকের নথিপত্রে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডের অফিসের ঠিকানা বনানীর বি ব্লকের ২৩ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ভবন। ঋণ পাওয়া মার্টস বিজনেস লিমিটেডের ঠিকানা বনানীর ডি ব্লকের ১৭ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে গিয়ে মিলল রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের অফিস। তবে মার্টস বিজনেস লাইন নামে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এভাবেই ভুয়া ঠিকানায় একাধিক কাগুজে কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র।
সব মিলিয়ে বিভিন্ন উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেওয়া হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয় চলতি নভেম্বর মাসের ১ থেকে ১৭ তারিখ সময়ে। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এ জন্যই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা চলতি মাসকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ বলে অভিহিত করছেন।
একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে কোম্পানিগুলো। ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে এসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়, যখন ব্যাংক খাতে ডলার সংকটের পর টাকার সংকট এখন বড় আলোচনার বিষয়।