জাতীয় সংসদে পেশকৃত আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৭ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে মূল বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির ১৫.২ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বা এডিপি তে বরাদ্দ ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। আর পরিচালন ব্যয় ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
এদিকে, অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারী বিনিয়োগ বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় চাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে আইএমএফ ঋণের শর্ত। এই শর্ত পালন করতে গিয়ে সরকারকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর আদায় করতে হবে জনগণের কাছ থেকে। এ জন্য চালু করা হবে সর্বজনীন করব্যবস্থা। অর্থাৎ কমপক্ষে দুই হাজার টাকা কর প্রত্যেককে গুনতে হবে। কর আদায়ের কৌশল হিসেবে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ৪৪ ধরনের সেবা পেতে এই কর দিতে হবে। সরকারের আয় বাড়াতে করপোরেট কর কমানো হচ্ছে না এবার।
এছাড়া, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেও বড় চ্যালেন্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে বলেন, "কঠিন, বাস্তবায়নযোগ্য নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এটি বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট নয়।"
রাজস্ব আদায় সম্পর্কে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এনবিআর এবারও প্রত্যক্ষ্য করের উপর বেশী নির্ভর করেছে। সবচাইতে বড় নেতিবাচক দিক হলো, কার ফাঁকি। নব্বই লাখ করদাতা রেজিষ্ট্রিভূক্ত তার মধ্যে মাত্র ৩০ লাখ কর দেয়াটা ভালো লক্ষ্মণ নয়।
বাজেটে এফডিআই বা বৈদেশিক বিনিয়োগ আনাতে কোনও উদ্যোগ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এফডিআই আনার মতো তেমন কিছু দেখি নাই। তবে করপোরেট কর বড়ানো হয়নি এটা একটি ভালো দিক। ভূমি রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বাড়ছে এটি নেতিবাচক দিক। দূর্নীতিও একটি চ্যালেন্জ। এছাড়া, মুডি`স এর বাংলাদেশের ঋণমান কমানোও এফডিআই আনার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। যারা আসবে তারা রিস্ক প্রিমিয়াম টা এসেস করে দেখবে।
শেয়ারবাজার সম্পর্কে বলেন, কর বাড়ানো হয়নি এটা ইতিবাচক দিক। ওরা ভয়ে ভয়ে ছিলো যে কর বাড়ানো হতে পারে। সেটা হয়নি। এর প্রভাব পড়বে বাজারে।
তিনি বলেন, সরকার একটা জিনিস করেছে যে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ সম্পর্কে কিছু বলেনি।
এখন যাদের এমন টাকা আছে তারা বুঝুক। কি করবে না করবে। কতোরকম টেকনিক তো আছে। হুন্ডিও একটি পথ। এর মাধ্যমেও টাকা আনা নেয়া করা যায়।
ড. এম মাশরুর রিয়াজ, চেয়ারম্যান
পলিসি এক্সচেঞ্জ, বাংলাদেশ
বাজেটে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা কে `অবাস্তব` বলে মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেছেন, চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উচ্চপ্রবৃদ্ধিতে ছাড় দিয়ে স্হিতিশীলতা ধরে রাখা বেশী জরুরী।
দি রিপোর্ট ডট লাইভ কে বাজেটোত্তর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, "কেবল বাজেট পেশ হলো। সময় আছে। অন্তত তিন ক্ষেত্রে বাজেটকে জাস্টিফাই বা বাস্তবসম্মত করা উচিত। এক. প্রবৃদ্ধি অর্জন, দুই. বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা, তিন. রাজস্ব আদায়।"
ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ২৮ শতাংশ বিনিয়োগ ও ১৬ শতাংশ রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান সময়ে বাস্তবতা বিরোধী। এটি করতে গেলে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট খারাপ হতে থাকবে।
তিনি বলেন, এছাড়াও ডলার সংকট তীব্র হবে, একইসাথে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বর্ধিত মূল্য পরিস্হিতি শিল্প উৎপাদন ব্যাহত করবে।
তিনি বলেন, চড়া মূল্যস্ফীতি সামষ্টিক অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। এরপর আবার উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে ব্যাংকঋণ পরিস্হিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।
ড. মাশরুর বলেন, সরকারের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে ১৫ শতাংশের মতো। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে চরম দূর্ভোগ সৃষ্টি হবে।
মনজুর আহমেদ
ট্রেড এন্ড ট্যারিফ পলিসি আ্যাডভাইজার
এফবিসিসিআই
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) আ্যাডভাইজার মনজুর আহমেদ বলেছেন, প্রাক বাজেট আলোচনায় দেয়া ব্যবসায়ীদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি এবারের বাজেটে।
তিনি বলেন, এ বাজেট বাস্তবতা বিরোধী।
এদিকে, বাজেটে ঘাটতির পরিমান ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫.২ শতাংশ। গত বাজেটে এ ঘাটতি ছিলো ৫.৫ শতাংশ বা ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি যা সংশোধিত বাজেটে নেমে আসে ৫.১ শতাংশে। টাকার অংকে এর পরিমান ছিলো ২ লাখ ২৭ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
ঘাটতি পূরণে চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৪০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীন উৎস থেকে ও ৮৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস হতে যোগান দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আগামী বাজেটে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীন উৎস ও ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস হতে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম. মুস্তাফা কামাল বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্হিতি মোকাবিলা ও দ্রুত পুনরুদ্ধার এবং জনগনের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের সাফল্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
করোনার সংকট কাটাতে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ২৮ টি প্রনোদনা প্যাকেজ নিয়ে জরুরী স্বাস্হ্যসেবা, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা পরিধি সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, এ প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হবে। যখন যে পরিস্হিতিতে যা দরকার তাই করবে সরকার।