ব্যাংকিং ব্যবস্থা

আমেরিকায় ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে পরিণতি কী!

এম মনিরুল আলম

জুলাই ৩০, ২০২৩, ০৫:১৩ এএম

আমেরিকায় ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে পরিণতি কী!

সংগৃহীত ছবি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে কী হয়? আমানতকারীরা কি টাকা ফেরত পায়? ঋণ নেওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর্থিক দায়মুক্তি পায় কি না? অর্থনীতিতেই বা এর প্রভাব কেমন হয়? চলতি বছরের সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্থনীতিতে শক্তিধর মার্কিন মুল্লুকে পরপর চারটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ প্রশ্নগুলো সামনে চলে এসেছে। 

সর্বশেষ গত শুক্রবার (জুলাই ২৮) বন্ধ হয়ে গেছে হার্টল্যান্ড ট্রাই-স্টেট ব্যাংক অব এলখার্ট। এর আগে গত মার্চ-এপ্রিল-মে সময়ে বন্ধ হয়েছে ফাস্ট রিপাবলিক, সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক।

সম্ভবত ২০০৮ সালে অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক ওয়াশিংটন মিউচুয়ালসহ ওই বছরে আমেরিকায় মোট ২৫টি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর তিন বছরে বন্ধ হয় মোট ৪০০ ব্যাংক। সে সময় মার্কিন অর্থনীতি হোঁচট খায়। চলে রিসেশন বা অর্থনৈতিক মন্দা। বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে তার প্রভাবও পড়ে দীর্ঘমেয়াদে। তবে সে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে আমেরিকা। সাথে মন্দায় পড়া দেশগুলোও অর্থনৈতিক উত্তরণ ও উন্নয়ন ঘটায়। 

এরপর কোভিড-১৯ এর টোটাল শাটডাউনে পড়ে আমেরিকাসহ গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি। পরিস্থিতির সমায়িক উত্তরণ ঘটে। কিন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হয় এক ধরনের নীরব মন্দা। এ যুদ্ধে আমেরিকা ইউক্রেনকে সামরিক ও নগদ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে জানুয়ারিতে সরকারের অনুমোদিত ঋণসীমা ৩১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়নের সর্ব্বোচ্চ স্তরে পৌছে। সমালোচকদের মধ্যে জুন মাসের পর আমেরিকার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা নিয়েও তোলপাড় আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে কংগ্রেস সরকারের ঋণসীমা বাড়িয়ে সে পরিস্থিতিরও উত্তরণ ঘটিয়েছে। তাহলে ব্যাংক বন্ধ হওয়ার জেরে কি মার্কিন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

এর সহজ জবাব হলো ‘না‍‍’। 

কারণ, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সকল নাগরিকের স্বার্থে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতে ব্যাংকিং রেগুলেশন তৈরি করেছে। এর দেখাশোনা ও নীতিমালা প্রবর্তন করে কংগ্রেস। এরপরই আছে বোর্ড অব গভর্নরস। এমন ১২টি ফেড আছে আমেরিকায়। প্রতিটি ফেড নিজস্ব বোর্ড অব গভর্নরস দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিটি ফেড-এ বোর্ড অব গভর্নরস-এর প্রতিনিধিত্বমূলক কমিটি রয়েছে যার নাম ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি। 

ন্যাশনাল ব্যাংকিং কোম্পানিকে অবশ্যই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের যে কোনো একটির সদস্য হতে হবে। আর এ সদস্যপদ প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত হলো একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে মার্কিন সরকারের ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (এফডিআইসি) এর কভারেজ নিতে হবে। এর উদ্দেশ্য হলো ব্যাংকটির সাথে আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষা দেওয়া। সুতরাং একটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে তার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে এমন নয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাংকের দায়িত্ব কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান নিবে এবং আর্থিক কার্যক্রম চলমান থাকবে। এ ধরনের ব্যবস্থার কারণে আমেরিকায় একটি বা কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হলেও অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ারোধে সমস্ত সিস্টেম কাজ করে।

এফডিআইসি‍‍র এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসেবে আমেরিকার ৫০ স্টেট বা অঙ্গরাজ্যে মোট ৪ হাজার ৮৪৪টি ব্যাংকিং কোম্পানি আর্থিক অপারেশনে রয়েছে। এর সবই এফডিআইসি কর্তৃক সুরক্ষিত। এর মানে হলো আমানতকারী তার আমানতের টাকা ফেরত পাবে। এফডিআইসি নিজে আমানতকারীর টাকা পরিশোধ করবে বা যে ব্যাংক বা আর্থিক কোম্পানি একটি বন্ধ হতে যাওয়া ব্যাংক টেকওভার করবে সে পরিশোধ করবে। একইসাথে বন্ধ হতে যাওয়া বা বন্ধ হওয়া ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতার দায় একই থাকবে। কারণ তার কাছে ঋণ দেয়া অর্থ ব্যাংকের সম্পদ। এ অর্থ টেকওভার করা ব্যাংক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে উদ্ধার করবে।

এবার আসা যাক, আমানতকারী কত টাকা এফডিআইসি থেকে পাবে? এফডিআইসি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতকারীকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করবে। তবে শর্ত থাকে যে ঐ আমানত ব্যাংক কর্তৃক এফডিআইসি‍‍র অনুকূলে ইনসিওরড বা বীমা নিরাপত্তায় কভারেজপ্রাপ্ত। তবে এর বেশি পরিমাণ অর্থ যদি কোনো আমানতকারীর থাকে তাহলে সে অর্থ কি তিনি ফেরত পাবেন না?

এ বিষয়েও নিরাপত্তা দেওয়া আছে আমানতকারীকে। এ ক্ষেত্রে এফডিআইসি সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংককে পরামর্শ দেয় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি আমানতকারীর টাকা অন্য একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে শেয়ার করে এফডিআইসিতে বীমা নিরাপত্তা কভারেজ নিয়ে রাখতে। তার মানে আমানতকারীরা মার্কিন ব্যাংকিং আইনে পূর্ণ সুরক্ষিত।

আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশে ব্যাংকিং আইন কী বলছে?

সর্বশেষ ব্যাংকিং কোম্পানি আইন ১৯৯১ (সংশোধিত ২০২৩) অনুযায়ী একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে একজন আমানতকারী সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা বীমা কভারেজ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) থেকে পরিশোধ করা হবে। এর আগে এই অর্থের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। তার মানে হলো এ পরিমাণের বেশি অর্থ থাকলে আমানতকারীর সে অর্থের কোনো নিরাপত্তা নেই।

আর এজন্যই একটি ব্যাংকের বড় অনিয়ম বা দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতির প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আমানতকারীরা ভিড় করেন টাকা তুলে নিতে। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি প্রকাশিত হয়েছে। 

২০১৯ সালে লিকুইডেট করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং এন্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা দেশ বিদেশে বহুল আলোচিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগে মামলাও হয়। সে মামলা চলমান রয়েছে।  এ দিকে আমানতকারীরা টাকা ফেরত পেতে আন্দোলন সংগ্রাম করেও অনেকে তাদের টাকা ফেরত পাননি।

Link copied!