জুলাই ২৮, ২০২৫, ১২:৩৩ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
‘অষ্টম শ্রেণিতে আবারও বৃত্তি পরীক্ষা ফিরছে, আছে প্রশ্নও’ শিরোনামে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের পর এবার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষাও আবার নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রায় সাত মাস পার হয়ে যাওয়ার পর এখন এ বছরই পরীক্ষাটি আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
ইতিমধ্যে এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ পরীক্ষায় বন্ধ হয়ে যাওয়া জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার মতো সব শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে না; বাছাই করা নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থী এতে অংশ নিতে পারবে।
অবশ্য এ উদ্যোগ ঘিরে বিভক্ত মত রয়েছে শিক্ষাবিদদের মধ্যে। কেউ কেউ বলছেন, বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন শিক্ষায় বৈষম্য বাড়াতে পারে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবল নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী হবে। তাতে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কাও বাড়বে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ এবং কোচিং-প্রাইভেটনির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়ে অভিভাবকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপও বাড়াতে পারে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্য, দেশের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই শিখনঘাটতি নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে উঠছে, যার প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষেত্রে। তাই বিদ্যালয় পর্যায়ে সব শিক্ষার্থী কীভাবে শিক্ষাক্রম নির্ধারিত শিখন অর্জন করতে পারে, সে ব্যবস্থার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বেশি সহযোগিতা করা দরকার। আর মেধাবীদের পুরস্কার আরও নানাভাবে দেওয়ার সুযোগ আছে, পরীক্ষাই একমাত্র উপায় নয়। তাই বিদ্যালয় পর্যায়ে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার গুণগত মান কীভাবে উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এখনই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত হলে তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
২০১০ সালের আগে পৃথকভাবে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো। তখন এর জায়গা নেয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা, যেখানে সব শিক্ষার্থী বৃত্তির জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। কিন্তু ২০১০ সালে চালু জেএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে কোচিং-প্রাইভেটের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে এ পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বিবেচনায় আর এ পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষাও করোনার সংক্রমণ শুরুর পর বন্ধ ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের শেষের দিকে হঠাৎই তা চালুর সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখনো বিশেষজ্ঞদের আপত্তি ছিল। পরে সেই পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ভুল-অসংগতি ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে আবারও পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষা আবার চালু হচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষাও ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় চলছে। এ লক্ষ্যে ২০ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় জানানো হয়, এ বছরই জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। তবে পরীক্ষাটি কারা নেবে, সে সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আগে এ পরীক্ষা পরিচালনা করত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। অন্যদিকে জেএসসি পরীক্ষা নিয়েছে শিক্ষা বোর্ড। এখন দুই পক্ষই পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলিতে রয়েছে।
জেএসসি পরীক্ষা চালুর আগে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা মাউশির আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে এ পরীক্ষা হতো। কিন্তু ২০১০ সালে জেএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিক্ষা বোর্ডের অধীন। যেহেতু বোর্ড সার্টিফিকেট পরীক্ষার নেওয়ার আইনি প্রতিষ্ঠান, সে জন্য তারা এ পরীক্ষা নিত। এ অবস্থায় শিক্ষা বোর্ড বলছে বৃত্তি পরীক্ষা মাউশির অধীন হোক। কিন্তু মাউশি বলছে, এ পরীক্ষা তাদের অধীনে নেওয়া কঠিন। তাই জেএসসির মতো শিক্ষা বোর্ডের অধীন এ পরীক্ষা হোক।
অষ্টম শ্রেণির কত শতাংশ শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে প্রাথমিক বৃত্তির মতো ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য বৃত্তি পরীক্ষা সহায়ক নয়। এতে কেবল কিছু ভালো শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেবে এবং তারা পুরস্কার পাবে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকেরা নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীর ওপর মনোযোগী হবেন, অন্যদের প্রতি অবহেলা হতে পারে। এটি চালু করে শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে বরং সমস্যাকে ঢেকে রাখার জন্য কি না, সেই প্রশ্নও আসে। তাই গরিব ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনা করে আরও কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সেটি বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থীই যাতে ভালো করে শিখতে পারে, সে জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।